নতুন ও পুরোনো প্রযুক্তির এক প্রাণঘাতী সমাবেশ ইউক্রেন যুদ্ধ
প্রযুক্তির কথা উঠলে এককথায় ইউক্রেন যুদ্ধকে এক গোলমেলে ব্যাপার বলেই মনে হয়। একদিকে, এটিই প্রথম বড় যুদ্ধ যেখানে মানবহীন আকাশযান – ইউএভি বা ড্রোন – বিশাল ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে ড্রোনের হামলা আর নজরদারি এড়াতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিখায় আশ্রয় নিতে হচ্ছে পদাতিক সেনাদের।
ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া কিছু প্রযুক্তি মৌলিকত্বের বিচারে একেবারেই নতুন নয়, যেমন গাইডেড মিসাইল। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকেই নাৎসি জার্মানিতে এ প্রযুক্তির যাত্রা শুরু, পরের দশকগুলোয় যার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।
প্রিসিশান গাইডেড আধুনিক বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যভেদে আরো বেশি নির্ভুল। কিন্তু লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দিচ্ছে মানুষই, সেখানে মানবিক ভুলত্রুটি বা শত্রুর জ্যামিং সক্ষমতার কারণে প্রায় সময়ই এগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে।
বিংশ শতকের শেষদিকের বা একবিংশ শতকের প্রথমদিককার 'ছোট যুদ্ধগুলোয়' বিবাদমান একটি পক্ষের ছিল অন্য পক্ষের চেয়ে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব। ইউক্রেন যুদ্ধের অভিনবত্ব হলো এই দিকটি না থাকা।
উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আফগানিস্তানের তালেবান যোদ্ধাদের কাছে স্যাটেলাইট ইমেজিং প্রযুক্তি, বড় আকারের ড্রোন বা প্রিসিশান গাইডেড মিউনিশন– এর মোকাবিলা করার কোনো উপায়ই ছিল না। এজন্যই বাধ্য হয়ে তাদেরকে প্রচলিত কৌশলের বাইরে 'অসম যুদ্ধ' লড়তে হয়েছে।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে বিবাদমান দুই পক্ষেরই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে, আর নিজস্ব উদ্যোগেও রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ফলে কোনো পক্ষই একক প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেনি।
ছোট ড্রোনের উত্থান
যুদ্ধে বড় ড্রোনের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। যেমন ইরাক ও আফগানিস্তানে রিপারের মতো বড় ড্রোন ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নজরদারি ও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে হত্যা– উভয় কাজেই এ ড্রোন ব্যবহার করা হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে লড়াই করার সময়ে রুশ বাহিনীও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বড় আকারের ড্রোন ব্যবহার করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে যেটা নতুন– তা হলো বিপুল সংখ্যায় নানান আকার ও ধরনের ড্রোনের ব্যবহার। এই সংঘাতে এখনও বড় ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে, যেমন ইরানের তৈরি শাহেদ কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া। এই ড্রোন শত্রুর প্রতিরোধ সারির অনেক পেছনে গিয়ে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু, সম্মুখসারির কাছাকাছি – প্রতিপক্ষের ওপর নজরদারি ও কামানের লক্ষ্যবস্তু শনাক্তের জন্য উভয়পক্ষই অপেক্ষাকৃত ছোট ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। ছোট ড্রোনকেও আত্মঘাতি ড্রোন বা কামিকাজে ড্রোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
যুদ্ধের শুরুতে ড্রোন ব্যবহারে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল ইউক্রেন– এখন সেক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। মস্কো বিপুল সংখ্যক ড্রোন আমদানির পাশাপাশি উৎপাদনও করছে। একইসঙ্গে ইউক্রেনীয় ড্রোনের হামলা ঠেকাতে আঞ্চলিক পর্যায়ে বেশ কার্যকর পাল্টা-ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে।
তবে জাদুর চমক দেখিয়েছে ইউক্রেনের তৈরি নৌ-ড্রোন। কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনীর জন্য সেগুলো আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দুই ডজনেরও বেশি রাশিয়ার জাহাজ ধ্বংসের দাবি করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। সংখ্যাটা কমবেশি যা-ই হোক, সেটা মস্কোর জন্য একটি বিব্রতকর বিষয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সবশেষ সের্গেই কোতভ নামের যুদ্ধজাহাজ ডুবেছে এই ড্রোনের হামলায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধজাহাজের তুলনায় আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলোয় অজস্র বিমান-বিধ্বংসী কামান নেই। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এসব কামান দিয়েই জাপানি কামিকাজি পাইলটদের প্রতিরোধ করা হতো। সে তুলনায়, আধুনিক যুদ্ধজাহাজকে শত্রুর দ্রুতগতির জেট বিমানের হুমকি মোকাবিলায় বিমান-বিধবংসী মিসাইলে সজ্জিত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। আর এখানেই তৈরি হয়েছে নৌ-ড্রোন ঠেকানোর দুর্বলতা। ইউক্রেনীয়রা রাতের আঁধারে মানবহীন স্পিডবোট সদৃশ এসব ড্রোনের ঝাঁক দিয়ে রুশ জাহাজগুলোকে টার্গেট করছে।
আত্মঘাতি নৌ-ড্রোন ধবংস করতে প্রচলিত কামান ও মেশিনগানই সবচেয়ে কার্যকর। ফলে অচিরেই আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলো আরো বেশি কামান-সজ্জিত হয়ে উঠবে বলে ধারণা করাই যায়। ইতোমধ্যেই কৃষ্ণসাগরের বন্দরে ইউক্রেনীয় নৌ ড্রোনের প্রবেশ ঠেকাতে টর্পেডো নেট ব্যবহার করছে রুশ নৌবাহিনী। সেই সুবাদে ১৯ শতকের এই প্রযুক্তি একবিংশ শতকের যুদ্ধে ফিরে এসেছে।
মিসাইল প্রযুক্তি
ইরাক ও আফগানিস্তানে– যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলো গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের বিপুল ব্যবহার করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধেও আমরা তা দেখছি। তবে এখানে নতুনত্ব হলো– উভয়পক্ষের কাছেই এ ধরনের মিসাইল রয়েছে।
যেমন রাশিয়ার ইস্কান্দার বা যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের তৈরি স্ট্রোম শ্যাডো মিসাইল– ফ্রন্টলাইনের অনেক পেছনের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানার ক্ষেত্রে– অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনেকসময় এসব ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট নির্ধারণ করা হচ্ছে ড্রোনের মাধ্যমে।
বহুসংখ্যক ট্যাংক কেবল ড্রোন দিয়েই ধবংস করা হয়নি, এজন্য রাশিয়ার করনেট বা যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাভলিনের মতো অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইলও ব্যবহার করা হয়েছে।
ট্যাংক-ঘাতক মিসাইল নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়। ১৯৭৩ সালের ইয়ুম কিপুর যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি প্রথম প্রজন্মের অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলি ট্যাংক বহরকে নাকাল করেছিল মিশরিয় সেনারা।
তবে বর্তমানে ইউক্রেনে ব্যবহৃত ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আরো বেশি উন্নত। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া মিসাইলগুলো ছিল ওয়ার গাইডেড। অর্থাৎ, মিসাইলের শেষপ্রান্তে থাকতো একটি তার, যার মাধ্যমে শত্রুর ট্যাংকের দিকে এটিকে গাইড করতেন মিসাইলের অপারেটর। কিন্তু, আধুনিক মিসাইলগুলোর গাইডেন্স ব্যবস্থা আরো বেশি উন্নত এবং রয়েছে নির্ভরযোগ্য টার্গেটিং প্রযুক্তি।
নতুন ও পুরোনো প্রযুক্তির সম্মিলন
শত্রুর গতিবিধি বা অবস্থান জানতে উভয়পক্ষই যেসব ড্রোন ব্যবহার করছে– সেগুলো মূলত পুরোনো প্রযুক্তির অস্ত্রকে – যেমন প্রচলিত কামানের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে সহায়তা করছে। কখনোবা তা ব্যবহার হচ্ছে পদাতিক বাহিনীকে সামনে কী বাধা/ বিপদ রয়েছে সে সম্পর্কে জানাতে।
নয়া প্রযুক্তি ইউক্রেনে লড়াইকে রূপান্তর করছে– এটা যেমন সত্য, তেমনি এমন অনেক বিষয়ই রয়েছে যা একনজর দেখেই চিনতে পারতেন প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনারা।
যেমন প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত যতই থাক– মহাযুদ্ধের মতোই 'বেচারা পদাতিক সেনাদের' শত্রুর এলাকা দখলে এগোতে হচ্ছে। লড়তে হচ্ছে একদম কাছাকাছি দূরত্বে। লড়াই হাতাহাতির দূরত্বে চলে আসলে– আজো এক সৈনিককে খুব কাছে থেকেই আরেক সৈনিককে হত্যা করতে হচ্ছে।
আজকে ব্যবহৃত প্রযুক্তি নতুন হতে পারে– কিন্তু যেকাজে বা উদ্দেশ্যে তা করা হচ্ছে – সেটি কিন্তু নতুন নয়। যেমন আজকের দিনে ড্রোন নজরদারির যে ভূমিকা রাখছে, প্রথম মহাযুদ্ধে সেই কাজ করেছিল পর্যবেক্ষক বেলুন। তখন কামানের গোলাবর্ষণের নিশানা ঠিক করতে এর ব্যবহার হয়েছে।
পরে অবশ্য বিমান ও বিমান-বিধ্বংসী কামানের মতো অস্ত্র আবিষ্কার হয়– যেগুলো দিয়ে সহজেই বেলুন ভূপাতিত করা যায়। একারণে যুদ্ধে অবজার্ভেশন বেলুনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
ঠিক একইভাবে যুদ্ধে নতুন কোনো প্রযুক্তি আসলে– তা মোকাবিলায় প্রতিপক্ষও সচেষ্ট হয়। শুরু হয় এক প্রযুক্তির ইঁদুর দৌড়। ইতোমধ্যেই ড্রোন অপারেটর এবং ড্রোনের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী সংযোগকে জ্যাম করতে বেশ সফলতা পেয়েছে রুশ বাহিনী। প্রযুক্তির নিত্য এ লড়াইয়ে– সামনে কী অপেক্ষা করছে, সেটাই মূল প্রশ্ন।
যুদ্ধের কাজে স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত ড্রোন ব্যবহার একটি ভয়ংকর আইডিয়া। তবু যুদ্ধের প্রয়োজনেই এনিয়ে কাজ চলছে। সন্দেহ নেই এরপর আমরা এআই- চালিত ড্রোন-বিধবংসী ড্রোনও দেখব।
নিশ্চিতভাবে বলা যায় একটি বিষয়, আর তা হলো নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন ঘটবে, তার বিরুদ্ধে পাল্টা-ব্যবস্থারও বিকাশ ঘটবে। হত্যাযজ্ঞের পুরোনো পদ্ধতির পাশাপাশি নিত্যনতুন হাইটেক সংযোজনও আমরা দেখব। কারণ, মানুষই এমন এক প্রজাতি– স্বজাতি ধবংসে যাদের বিনিয়োগ কল্পনাতীত।
লেখক: অ্যালেক্সান্ডার হিল কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক।