বিল গেটসের অর্থায়নে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে জ্বালানি তৈরি করছে যে স্টার্টআপ
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের শহর কর্পাস ক্রিস্টি মূলত জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। এ বন্দরনগরীতে রয়েছে কয়েক ডজন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেলও আমদানি করে শহরটি।
তবে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর এ কর্পাস ক্রিস্টিতেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে জ্বালানি উৎপাদন করছে একটি স্টার্টআপ।
গত অক্টোবরে কর্পাস ক্রিস্টিতে কার্যক্রম শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক স্টার্টআপ কোম্পানি ইনফিনিয়াম।
ইনফিনিয়ামের প্ল্যান্টে ইলেক্ট্রোলাইজার দিয়ে পানিকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে ভাঙা হয়। এ কাজে আশপাশের বায়ু ও সৌর প্রতিষ্ঠান দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এরপর হাইড্রোজেনকে পাঠানো হয় একটি রিঅ্যাকটরে। সেখানে স্থানীয় পরিশোধনাগার থেকে ধারণ করা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সংস্পর্শে আসে এ হাইড্রোজেন। সেখানে বেশ কিছু জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। পরিণতিতে উৎপন্ন হয় একটি সিনথেটিক জ্বালানি, যার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য তার জ্ঞাতি ভাই জীবাশ্ম জ্বালানির মতোই।
ইনফিনিয়াম দিনে প্রায় ৮ হাজার ৩০০ লিটার সিনথেটিক জ্বালানি উৎপাদন করে। শিল্পে একে বলা হয় 'ইলেক্ট্রোফুয়েল' বা 'ই-ফুয়েল'। এ জ্বালানি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গ্রাহকদের সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি।
ট্রাক থেকে শুরু করে জেট বিমান পর্যন্ত সব বাহনের জ্বালানির ভিত্তিই হচ্ছে হাইড্রোকার্বন—হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত যৌগ। তবে এসব পরমাণু থেকে বিকল্প জ্বালানি তৈরি সম্ভব, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর যার প্রভাব কম হবে।
বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ২ শতাংশই হয় বিমান চলাচল থেকে। আর ৮ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয় পণ্য পরিবহন—মূলত ট্রাক, জাহাজ রেলের মাধ্যমে—থেকে। ভ্রমণ ও পরিবহনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সামনে এ হার আরও বাড়বে।
এই পরিস্থিতিতে সমস্যার অন্যতম সমাধান হতে পারে ই-ফুয়েল। পাঁচ বছর আগেও ই-ফুয়েল বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব ছিল না। আর ২০৩০ সাল নাগাদ ই-ফুয়েলের বাজারের আকার ৫০ বিলিয়ন ডলার ছোঁবে বলে ধারণা শিল্পসংশ্লিষ্টদের।
ই-ফুয়েলের বাণিজ্যিক উৎপাদন এখনও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে এর প্রতি মানুষ 'প্রচুর আগ্রহ' দেখাচ্ছে।
ইনফিনিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রবার্ট শুয়েটজলে বলেন, পরিবহনকে কার্বনমুক্ত করতে 'বড়' ভূমিকা রাখতে পারে ই-ফুয়েল।
তিন বছর বয়সি এ স্টার্টআপের টেক্সাসসহ অন্যান্য জায়গায় ১৩টি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ইনফিনিয়ামের কর্পাস ক্রিস্টি প্ল্যান্টে মূলত ট্রাকের জন্য ই-ডিজেল উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি জেট ফুয়েল হিসেবে ই-কেরোসিন এবং ই-ন্যাফথাও উৎপাদন করা হয়।
প্ল্যান্টটি পূর্ণ সক্ষমতায় চললে বছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন টন ই-ফুয়েল উৎপাদন করতে পারে।
২০৪০ সাল নাগাদ নিঃসরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া অ্যামাজনও ই-ফুয়েল নিচ্ছে ইনফিনিয়াম থেকে।
এছাড়া টেকসই বিমান-জ্বালানি উৎপাদনের জন্য পশ্চিম টেক্সাসেও আরেকটি প্ল্যান্ট করছে ইনফিনিয়াম। আমেরিকান এয়ারলাইনস ইতিমধ্যে সেখান থেকে জ্বালানি নিতে সম্মত হয়েছে। ২০২৬ সালে এ প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
ইনফিনিয়ামের ভবিষ্যৎ কেমন হয়, তা-ই এখন দেখার বিষয়। প্রতিষ্ঠানটির ই-ফুয়েল 'বেশি ব্যয়বহুল' বলে স্বীকার করে নিলেও শুয়েটজলে প্রকৃত ব্যয় কত, তা জানাননি।
ইলেক্ট্রোলাইসিসের মাধ্যমে হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন। যদিও ইনফিনিয়াম বলছে, তাদের পানির ব্যবহার 'অত্যন্ত সাশ্রয়ী'।
স্টার্টআপটি বলছে, তাদের পণ্য প্রথাগত জ্বালানির চাইতে ৯৫ শতাংশ কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। একে 'নিট-শূন্য কার্বন জ্বালানির খুব কাছাকাছি' বলে উল্লেখ করেন ইনফিনিয়ামের প্রধান নির্বাহী।
তবে সবাই অবশ্য এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক পিয়েরপাওলো ক্যাজোলা বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে চলা কারখানা থেকে পরিবেশে নিঃসরণ হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে তুলনা করলে কার্বন ধারণ করে একে ই-ফুয়েল উৎপাদনের ব্যবহার করাটা বেশি জলবায়ুবান্ধব। কিন্তু গ্যাসটিকে সাময়িকভাবে আটকে রাখা হয়। ই-ফুয়েল পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেটি প্রথাগত জ্বালানির মতোই সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে।