ঘরের চাবিই এখন গাজার পরিবারগুলোর কাছে বারবার বাস্তুচ্যুতির স্মারক
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/07/09/1.jpg)
গাজার বাসিন্দা হাসান নোফেল তার চাবির রিংয়ে দুটি বাড়ির চাবি রেখেছেন। একটি বাড়ি দক্ষিণ ইসরায়েলে। এটি তার দাদা-দাদির বাড়ি ছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি বাহিনী এ বাড়ি থেকে তাদের বিতাড়িত করেছিল। তারা আর কখনোই ওই বাড়িতে ফিরতে পারেননি।
আরেকটি বাড়ি উত্তর গাজায় অবস্থিত। পরিবার নিয়ে এ বাড়িতেই থাকতেন হাসান। গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলা শুরু হলে এ বাড়িও ছাড়তে বাধ্য হয় তার পরিবার।
এরপর থেকে প্রায় নয় মাসে হাসান ও তার পরিবার চারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তারা গাজার যেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার ভয়ে সেখান থেকেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে হাসান পরিবার নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরতে চান। তাদের বাড়ির অবস্থা তার দাদা-দাদির বাড়ির মতো হোক, সেটা তিনি চান না।
হাসান বলেন, 'আমার বাড়ির চাবি যদি কেবল একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়, তাহলে আমি আর বাঁচতে চাই না। আমাকে অবশ্যই আমার বাড়িতে ফিরতে হবে...আমি গাজায় থাকতে চাই এবং আমাদের বাড়িতে আমার সন্তানদের নিয়ে গাজায় বসতি গড়তে চাই।'
ইসরায়েল বলেছে, ফিলিস্তিনিদের শেষ পর্যন্ত গাজায় তাদের বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হবে। তবে সেটি কখন, তা স্পষ্ট নয়। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় বহু বাড়িঘর ধ্বংস ও ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলা শুরুর পর থেকে ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সর্বশেষ গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিস থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরায়েল। এরপর ফিলিস্তিনিরা শহরটি ছাড়তে শুরু করেন। ইসরায়েল ঘোষিত 'হিউম্যানিটেরিয়ান সেফ জোন' মুওয়াসি নামক এলাকায় আশ্রয় নেন। 'সেফ জোন' বলা সত্ত্বেও ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায়। সেখানকার জীবনযাত্রার পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই, রয়েছে সুপেয় পানির অভাব। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের অবস্থাও একেবারে নাজুক।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/07/09/3.jpg)
৫৩ বছর বয়সী হাসান জানান, তিনি, তার স্ত্রী ও ছয় সন্তান গত অক্টোবরে জাবালিয়ার উত্তর শরণার্থী শিবিরে অবস্থিত তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। প্রথমে তারা কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহ, তারপর সেখান থেকে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে যান। গত মে মাসে ইসরায়েল সেখানে হামলা শুরু করলে এবং খান ইউনিসের কাছাকাছি চলে গেলে তারা আবার পালাতে বাধ্য হন। গত সপ্তাহে তারা খান ইউনিস থেকে মুওয়াসিতে চলে যান। সেখানে একটি তাঁবুতে তারা এখন আশ্রিত রয়েছেন।
হাসান বলেন, 'ঘরবাড়ি হারিয়ে নতুন কোনো জায়গায় বালুর মধ্যে বসবাস করা সত্যিই কঠিন। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কারণ এখানে দিনের বেলায় গরম আর রাতে ঠান্ডা।'
তিনি বলেন, 'প্রথমবার জাবালিয়ার বাড়ি ছাড়ার মুহূর্তটি সবচেয়ে কঠিন একটি মুহূর্ত ছিল।'
হাসানের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তার হাতে ছিল চাবির ছড়াটি। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জেরে ১৯৪৮ সালের সংঘাতে ঘরবাড়ি হারানো ফিলিস্তিনিদের বংশধরদের কাছে পুরনো এসব চাবি খুবই মূল্যবান সম্পদ।
উত্তর গাজার বাসিন্দা ওলা নাসারের হাতেও তার ঘরের কয়েকটি চাবি দেখা গেল। তার কাছে এগুলো 'নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও স্বাধীনতার প্রতীক।'
তিনি বলেন, 'এটা আমার পরিচয়ের মতো।'
গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে আগে বাড়ির রান্নাঘরটি নতুন করে তৈরি করেছিলেন ওলা। এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েলি হামলায় তার বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি, তার স্বামী ও তিন সন্তান যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই গাজার এ শহর থেকে ও শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ পর্যন্ত সাতবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তারা। এখন তারা মুওয়াসিতে একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন।
ওলা নাসার বলেন, 'প্রতিটি বাস্তুচ্যুতদের অভিজ্ঞতাই খুব কঠিন ছিল। কারণ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। আর যে সময়ে আমরা সবেমাত্র মানিয়ে নেওয়া শুরু করেছি, দেখা গেছে তখনই আবার আমাদের সেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খাবারের সংকট। এমন অনেক দিন গেছে যেসব দিনে আমরা কেবল একবেলা খেতে পেরেছি।'
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/07/09/2.jpg)
ইসরায়েলি হামলার জেরে ফিলিস্তিনিরা ঘরবাড়ি ছাড়ার সময় বেশি কিছু সঙ্গে নিতে পারেননি। কেবল কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন তারা।
নুর মাহদি নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, তিনি কেবল বাড়ির চাবি, মালিকানা প্রমাণের জন্য তার অ্যাপার্টমেন্টের দলিল ও সাত সন্তানের একটি ফটো অ্যালবাম সঙ্গে নিয়েছিলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে সেই অ্যালবামটিও নষ্ট হয়ে যায়।
গাজার বাইত হানুনের বাসিন্দা ওমর ফায়াদ। তিনি তার বাড়িটি কখনোই হারাতে চান না। ৫৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বলেন, 'এটি আমার জন্য খুবই ভালো হতো যদি আমি আমার বাড়িতে থাকতাম এবং সেখানেই মারা যেতাম।'
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক