‘দেশের নিজ ছেলের কথা ভাবছিলাম’: সিঙ্গাপুর প্রবাসী জহির যেভাবে শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে পুরস্কৃত হলেন
জানালার ধারে বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা তিন বছরের একটি ছেলের জীবন বাঁচানোর জন্য সিঙ্গাপুরে এক বাংলাদেশি শ্রমিককে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। জহির নামের ঐ কর্মী ভিড় দেখে মূলত ছবি ও ভিডিও তুলতে যায়। তখন তিনি দেখতে পান, শঙ্কিত অবস্থায় ফ্ল্যাটের তৃতীয় তলায় জানালার বাইরে সানশেডে দাঁড়িয়ে আছে তিন বছরের এক বালক। শিশুটি কী করবে তা বুঝতে না পেরে হতবাক ও নিথর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
জহির একটি পেপার মিল কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে থাকছেন। এক্ষেত্রে ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য গত ২৫ অক্টোবর সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্স (এসসিডিএফ) এর কমিউনিটি লাইফসেভার অ্যাওয়ার্ডে পেয়েছেন তিনি।
মূলত শিশুটিকে সানশেড থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, গত ২০ অক্টোবর সকাল ১১.৫০ এর দিকে শিশুটি ফ্ল্যাটের তৃতীয় তলার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন কী করবে সেটি বুঝতে না পেরে নিচে বহু লোক ভিড় জমিয়েছিল।
জহির মূলত তখন সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি ভিড় খেয়াল করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
ঐ ঘটনার স্মরণ করে জাহির বলেন, "যে মুহূর্তে আমি তাকে দেখেছিলাম, বাংলাদেশে থাকা আমি আমার সাত বছরের ছেলের কথা ভেবেছিলাম। আমি শুধু ছেলেটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষা করার সময় ছিল না। আমি চিন্তায় ছিলাম যে, সে পড়ে যাবে।"
জহির সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা দিল। যেই ফ্লাটের জানালার কাছে ছেলেটি ছিল।
জহির দরজায় ধাক্কা দিলেন, চিৎকার করলেন ও ডোরবেল বাজান। কিন্তু তিনি কোনও সাড়া পাননি। হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি ছেলেটিকে বাঁচাতে ঐ সানশেডে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন।
এক্ষেত্রে তৃতীয় তলায় দরজা খোলার চেষ্টা করলে জহির সেটি তালাবদ্ধ দেখতে পান। তারপর তিনি দোতলায় নেমে গেলেন এবং সেখান থেকে সানশেডে ওঠার চেষ্টা করেন।
তখন জহির দেখলেন চারজন লোক নিচে চাদর ধরে আছেন। যাতে করে শিশুটি পড়ে গেলে তাকে ধরা যায়।
এই সময় মায়ানমারের থেকে আগত শ্রমিক সা থু ইয়া অং জহিরের কাছে আসেন। ২৬ বছর বয়সি এই তরুণ পেশায় একজন রঙমিস্ত্রী। তিনি গির্জার একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে হট্টগোল দেখতে পেয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
থু ইয়ার ছয় বছর বয়সী ভাতিজি ও চার বছর বয়সী ভাতিজা রয়েছে। বিপদ্গ্রস্থ ছেলেটিকে দেখে তার তাদের কথা মনে পড়েছিল।
এক্ষেত্রে জহির ও থু ইয়া মিলে পরিকল্পনা করেন। জাহির লম্বা হওয়ায় তিনি থু ইয়াকে দ্বিতীয় তলার সানশেডে উঠাবেন। তারপর সেখানে পৌঁছে তিনি জহিরকে সেখানে তুলবেন। সেখান থেকে জহির থু ইয়াকে তৃতীয় তলার শেডে তুলবেন। এক্ষেত্রে থু ইয়া পড়ে গেলে জহির তাকে দ্বিতীয় তলায় থেকে ধরবেন বলে ঠিক করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে থু ইয়া দেয়াল আঁকড়ে ধরে ছেলেটির কাছে ধীরে ধীরে পৌঁছায়। তবে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন এই ভেবে যে, হঠাৎ নড়াচড়া করলে শিশুটি ভয় পেয়ে পিছলে যেতে পারে।
শেডটি থু ইয়ার পায়ের চেয়ে সামান্য প্রশস্ত ছিল। কিন্তু তবুও তিনি ভয় পায়নি।
থু ইয়া বলেন, "আমি ছেলেটির জন্য এত ভয় পাচ্ছিলাম যে, নিজের জন্যও এতো ভয় পাইনি। আসলে আমি ভিড়ের জন্য একটু বেশি নার্ভাস ছিলাম। কারণ অনেক লোক আমাকে দেখছিল।"
নিচে থাকা উদ্বিগ্ন লোকেরা সতর্ক থাকার জন্য চিৎকার করছিল এবং ছবি ও ভিডিও তুলছিল। এই কারণে উদ্ধার অভিযান আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল। যাই হোক, শিশুটির কাছে পৌঁছানোর পর থু ইয়া তাকে আগলে ধরে।
ঐ ঘটনার স্মরণ করে থু ইয়াং বলেন, "ছেলেটি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার হাত ঠান্ডা ছিল। সে আমার কাঁধে শক্ত করে ধরেছিল।"
ফ্ল্যাটের একটি জানালা সামান্য খোলা ছিল। তাই থু ইয়া ধাক্কা দিয়ে সেটি খুলে দিয়ে ছেলেটিকে ঘরের ভেতরে পাঠায়।
এক্ষেত্রে এমন অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ায় জহির ও থু ইয়াং দুইজনকেই লাইফসেফার পুরস্কারটি দেওয়া হয়। মূলত নিজে ঝুঁকি নিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে অবদানের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
জহির বলেন, "পুরস্কার আমার জন্য বাড়তি কিছু। ছেলেটির জীবন বাঁচাতে পারাটাই আসল পুরস্কার।"
এসসিডিএফ কমান্ডার লিম বেং হুই বলেন, "আমি থু ইয়া ও জাহিরের সাহসিকতায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। তাদের সাহসী পদক্ষেপ ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া একটি মূল্যবান জীবন বাঁচিয়েছে। আমি আশা করি তাদের কাজগুলি বিপদে অন্য মানুষকে এগিয়ে আসতে এবং সাহায্য করতে অনুপ্রাণিত করবে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান