অবৈধ অভিবাসীদের গণহারে ফেরত পাঠাতে ট্রাম্পের অটল অবস্থান; কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার অগ্রাধিকার হবে সীমান্তকে 'শক্তিশালী ও নিরাপদ' করা।
এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'এই পরিকল্পনার আর্থিক খরচ অনেক হলেও, বাস্তবে আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।' তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কী ধরনের আইনি জটিলতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে মার্কিন প্রশাসন?
যেসব আইনি চ্যালেঞ্জ রয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ ও পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন, যা ২০০৫ সালের পর থেকে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ অভিবাসী দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
আইন অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসীদের দেশছাড়া করতে হলে তাদের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, অভিবাসীদেরও আইনি লড়াইয়ের অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে আদালতে শুনানি অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ব্যাপক মাত্রায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চালানো হলে, আগে থেকেই প্রক্রিয়াধীন মামলায় পূর্ণ অভিবাসন আদালতের ওপর চাপ বাড়বে।
বেশিরভাগ অভিবাসী মূলত স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে নির্বাসন ব্যবস্থায় প্রবেশ করেন, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এজেন্টদের মাধ্যমে নয়। তবে দেশের অনেক বড় শহর ও কাউন্টি স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে আইসের সহযোগিতায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
ট্রাম্প এই শহরগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়, রাজ্য ও ফেডারেল আইনের জটিলতা এই বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের (এমপিআই) নীতি বিশ্লেষক ক্যাথলিন বুশ-জোসেফ বলেন, আইস এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা যেকোনো গণ-নির্বাসন কর্মসূচির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উদাহরণ দিয়ে জানান, ফ্লোরিডার ব্রোয়ার্ড এবং পাম বিচ কাউন্টির শেরিফ অফিসের আগষ্টের ঘোষণা অনুযায়ী তারা ট্রাম্পের গণ-নির্বাসন পরিকল্পনায় সাহায্য করবে না। এরকম অনেকেই এই পরিকল্পনার সাথে একমত নন, যা কার্যক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
এছাড়া, যেকোনো গণ-নির্বাসন কর্মসূচি শুরু হলে তা অবিলম্বে অভিবাসন ও মানবাধিকার কর্মীদের আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তবে, ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় অনুযায়ী, আদালত অভিবাসন প্রয়োগ নীতি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না, অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ চললেও কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলতে থাকবে।
বাস্তবে কি এর পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব?
যদি মার্কিন প্রশাসন গণ-নির্বাসনের পরিকল্পনা আইনগতভাবে বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে তাদের একাধিক কঠিন বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বাইডেন প্রশাসনের সময়, নির্বাসনের মূল লক্ষ্য ছিল সীমান্তে নতুন আটক হওয়া অভিবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যাদের নির্বাসন করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই অপরাধমূলক রেকর্ড বা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় কর্মস্থলে অভিযান পরিচালনা হলেও তা ২০২১ সালে স্থগিত করা হয়।
দেশের ভেতরে আটক হওয়া ব্যক্তিদের নির্বাসনের সংখ্যা গত দশকে প্রতি বছর ১ লাখের নিচে অবস্থান করছে, যা ওবামা প্রশাসনের শুরুর দিকে ২ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি ছিল।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের নীতি পরিচালক অ্যারন রাইকলিন-মেলনিক বলেছেন, যদি বছরে ১০ লাখ লোককে নির্বাসন করতে হয়, তবে এর জন্য অনেক সম্পদের প্রয়োজন, যা বর্তমানে সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইসের (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) ২০ হাজার এজেন্টও এতো বড় সংখ্যার লোক শনাক্ত করতে পারবে না।
মেলনিক আরও জানান, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। প্রথমে অভিবাসীকে শনাক্ত এবং আটক করা হয়, তারপর তাকে জেলে রাখা বা অন্য একটি প্রোগ্রামে পাঠাতে হয়, যেখানে মামলাগুলো বছরের পর বছর অপেক্ষমাণ থাকে। এরপর, কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে নির্বাসিত করা হয়। তবে, আইসের পক্ষে এই পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
ট্রাম্প বলেছেন, প্রত্যাবাসন কাজে সহায়তার জন্য ন্যাশনাল গার্ড বা অন্যান্য মার্কিন সামরিক বাহিনীকে জড়িত করবেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সীমান্তে সীমিত ছিল।
গণ-প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে খুব বেশি স্পষ্টতা দেননি ট্রাম্প। তিনি বলেন, নতুন আটক কেন্দ্র তৈরি করা এবং আইন প্রয়োগকারীদের মামলা থেকে রক্ষা দিতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করবেন।
নাম্বারসইউএসএ-এর গবেষণা পরিচালক এরিক রুয়ার্ক বলেন, দেশের ভেতরের অভিবাসীদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম কার্যকর করতে আগে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা অপরিহার্য। এছাড়া, অবৈধ অভিবাসীদের কাজ দিচ্ছে এমন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খরচ
বিশেষজ্ঞদের মতে, এক মিলিয়ন বা তার বেশি লোককে নির্বাসন করার খরচ কয়েকশো বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
২০২৩ সালে আইসের (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) পরিবহন ও নির্বাসনের জন্য বাজেট ছিল ৪২০ মিলিয়ন ডলার (৩২৭ মিলিয়ন পাউন্ড)। ওই বছর সংস্থাটি ১ লাখ ৪০ হাজারের কিছু বেশি লোককে প্রত্যাবাসন করেছে।
এছাড়া, নির্বাসন ফ্লাইটের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়াতে হবে, যার জন্য সামরিক বিমান ব্যবহার করা হতে পারে। এই খরচের মধ্যে সামান্য পরিবর্তনও শত মিলিয়ন ডলার বাড়াতে পারে।
"একটি ছোট পরিবর্তন আনলেও সেখানে দশ মিলিয়ন বা শত মিলিয়ন ডলারের খরচ হতে পারে, এবং একটি বড় পরিবর্তন হলে, সেটা শত শত মিলিয়ন ডলারের খরচ হতে পারে," বলেছেন রাইকলিন-মেলনিক।
এই খরচগুলো আরও বাড়বে যদি ট্রাম্প আরও কিছু সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যেমন দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, ফেন্টানাইল প্রবাহ ঠেকাতে নৌ-অবরোধ, এবং সীমান্তে হাজার হাজার সেনা পাঠানো।
লাতিন আমেরিকার ওয়াশিংটন অফিসের অভিবাসন ও সীমান্ত বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম আইজ্যাকসন বলেন, "গণ-নির্বাসনের ভীতিকর দৃশ্যাবলী রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।"
এর আগে কি কখনো গণ-প্রত্যাবাসন কার্যক্রম হয়েছে?
সীমান্ত ও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এলাকা মিলে, পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনে চার বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নির্বাসিত হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনও ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় ১১ লাখ লোককে নির্বাসন করেছে, যা কিছুদিনের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনেরই সমান হবে।
ওবামা প্রশাসনে বাইডেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়, তিন কোটিেরও বেশি লোক নির্বাসন হয়েছিল, যার ফলে কিছু অভিবাসন সংস্কার কর্মী বারাক ওবামাকে 'ডিপোর্টার-ইন-চিফ' বলে নাম দিয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালে অপারেশন ওয়েটব্যাক নামে পরিচিত একটি উদ্যোগে প্রায় ১৩ লাখ লোককে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তবে এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের অধীনে এই পরিকল্পনা শুরু হলেও তহবিলের অভাব এবং মার্কিন নাগরিকদেরও ভুলক্রমে নির্বাসনের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে এটি ১৯৫৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই সময়ে মূলত মেক্সিকান পুরুষদের নির্বাসনেই জোর দেওয়া হয়েছিল এবং এতে আইনি প্রক্রিয়ার যথেষ্ট অভাব ছিল। এমপিআই-এর কাথলিন বুশ-জোসেফ বলেন, 'এখনকার পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা, কারণ বর্তমান অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই মেক্সিকো বা উত্তর-মধ্য আমেরিকার বাইরের দেশ থেকে আসছেন। ফলে তাদের ফেরত পাঠানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন