বাংলাদেশের পাসপোর্টের মানের উত্তরণ ঘটছে না কেন?
বাংলাদেশি পাসপোর্টে যে একটামাত্র কাজের দেশটিতে ভিসার ঝামেলা ছাড়া যাওয়া যেত, সেটি ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু বেশ অনেক মাস ধরে আমাদের ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া দ্বীপে (একই দ্বীপের অন্য অংশে পাপুয়া নিউ গিনি অবস্থিত) বার্ডস অভ প্যারাডাইস দেখার জন্য যাবার পরিকল্পনা। সেজন্য আগাম অর্থ জমা দিয়ে রাখা হয়েছে দুই বছর হয়ে গেল।
কোভিডের কারণেই ট্রিপ পিছিয়েছিল, এখন পিছাচ্ছে ভিসার কারণে। কারণ আগে বাংলাদেশিরা স্রেফ উড়ে ইন্দোনেশিয়া নামলেই পোর্ট এন্ট্রি বা ভিসা ফ্রি সুবিধা পেতেন। কিন্তু মহামারিকালে সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সারা পৃথিবীর জন্যই।
এরপর সেই ব্যবস্থা আবার চালু হয়েছে, প্রায় শখানেক দেশের জন্য ইন্দোনেশিয়া পোর্ট এন্ট্রির দুয়ার উম্মুক্ত করে দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই তালিকায় উঠতে পারেনি!
বিশ্বের ৯ম দুর্বলতম পাসপোর্ট বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টে যে ৪১টি দেশে ইচ্ছে করে ধুম করে যাওয়া যায় বলে এই বছরেও তালিকা দেওয়া হয়েছে সেখানে বিশাল শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এই ৪১ দেশের মধ্যে ১১টাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপ। কে কবে বাংলাদেশ থেকে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরতে গেছে? এর মাঝে একাধিক দ্বীপদেশ বলে দিয়েছে যে সেখানে বাংলাদেশিদের যেতে হলে আগে আগেই আমেরিকার ভিসা নিয়ে যেতে হবে, যাতে মানুষ চোরাচালান রোধ করা যায়।
আর ১৬টি দেশ হচ্ছে আফ্রিকায়, যার মধ্যে কোনটি কোনটি আসলে কার্যকর সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে, কারণ সেনেগালে গিয়ে নিজেই ভীষণ বিপদের ভুক্তভোগী হয়েছিলাম। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ—এই ৪ দেশ বাদে আসলেই ইন্দোনেশিয়া ছিল একমাত্র কাজের দেশ, যেখানে ভ্রমণে যাওয়া যায় নানা কারণে এবং সহজে। দূরের বলিভিয়া বা মাদাগাস্কার যাওয়া তো এত সহজ নয় আমজনতার জন্য। সেই একটা দেশও বছরের পর বছর বন্ধ। কেন?
আমাদের কি কোনো মন্ত্রণালয় নেই, যারা ইন্দোনেশিয়ান সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেন যে ঈদের সময়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার পর্যটক নেপাল যান মূলত ভিসার ঝামেলামুক্ত বলেই। এটা ইন্দোনেশিয়া করলে করলে তো তাদেরই লাভ। সমস্ত পয়সা তো তাদের কাছেই যাবে। তাহলে কেন এই গড়িমসি, কেন এই অবহেলা?
আমরা নিজেরা নিজেদের নিয়ে যতই অহংবোধে ভুগি না কেন, এই পাসপোর্ট ইনডেক্স কিন্তু দেখিয়ে দেয় বিশ্বের অন্য দেশের কাছে আমাদের কী অবস্থান, এবং আমাদের তারা কী চোখে দেখে।
মনে আছে সেনেগালের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমাকে হেসে হেসে বলেছিলেন, 'শোনো, বাংলাদেশ হচ্ছে আমাদের তালিকায় সি ক্যাটাগরি দেশ।' শুনেই আমার রাগ ও বিরক্তি দেখে তিনি বলেছিলেন, 'রাগ কোরো না, এটা নাথিং পারসোনাল। এ ক্যাটাগরি মানে আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। বি ক্যাটাগরি মানে তোমার আর আমাদের বন্ধুত্ব আছে, অল্প বিস্তর ব্যবসা চলে, পরে উন্নতি হবে। আর সি ক্যাটাগরি মানে তুমিও আমাদের চেনো না, আমাদের নাগরিকদের সুবিধা দাও না, আর আমরাও তোমাদের চিনি না, এই-ই তো!'
আরেকবারের গল্প।
স্থান—ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো বিমানবন্দর। সময়—সম্ভবত ২০১২র গ্রীষ্ম।
ঘটনা—'ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?' বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন ইমিগ্রেশন অফিসার।
আমি—'অবশ্যই!' মনে মনে ভাবলাম বিশ্বকাপ ফুটবলে আমি যে ব্রাজিলের পাঁড় ভক্ত, পিচ্চিকাল থেকে তাদের জার্সি পরে ঘুরি সবখানে, পেলের পুরো নাম যে এডসন অরান্তেস দ্যো নাসিমেন্তো, ব্রাজিল কোন কোন বিশবকাপের ফাইনালে কত গোলে জিতেছিল, এবং কোন কাপে ফাইনাল না খেলেই রানার্স আপ হয়েছিল সেই কথা বলেই তাক লাগিয়ে দেব হে বাছাধন! বাঙালি ব্রাজিলিয়ান ভক্ত কী তা টের পাবে, হুঁ! একবুক উল্লাস নিয়ে তার কাছে যেতেই সে পুরোই বেগুনভাজার মত মুখ করে বলল, 'প্লিজ স্টেপ অ্যাসাইড!'
মানে কী! আলাদা কেন দাঁড়াব! এমনিতেই লম্বা লাইন! বোর্ডিং পাসের আগে কেন আলাদা করছে আমাকে? কী মুশকিল!
জানা গেল যে আমাদের ফ্লাইট যেহেতু রিও-লন্ডন-হেলসিংকি, তাই বিমান লন্ডনের মাটিতে নামবে ও সেখানে আমার থাকতে হবে ২ ঘণ্টা! আসার সময় তো লন্ডনের মাটিতে ৮ ঘণ্টার ট্রানজিটে দিব্যি ছিলাম, সেখানে তো আলাদা করে দাঁড় করায়নি!
ওই অফিসার চোখ গোলগোল করে বললেন, 'তুমি আসার সময় লন্ডন হয়ে এসেছ, ভিসা কোথায় ইংল্যান্ডের?' আমি সঙ্গে সঙ্গে আগের টিকিট—এমনকি বোর্ডিং পাসগুলোও সঙ্গে ছিল (যেগুলো সবসময়ই সংগ্রহ করি মূলত বুকমার্ক হিসেবে ব্যবহারের জন্য)—দেখিয়ে দিলাম!
অফিসার মাথা নেড়ে বলেন, 'কোথাও একটা ভুল আছে, তোমার হচ্ছে বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট। নতুন আইন হচ্ছে তুমি যদি লন্ডনের যেকোনো বিমানবন্দরে এক সেকেন্ডের জন্য নেমে একটা ঢোক পানিও খাও, তার জন্যও তোমার ভিসা লাগবে। এই দেখো, আমাদের সিস্টেমে এইটাই লেখা আছে।'
অফিসার মনিটর ঘুরিয়ে দেখাতেই দেখলাম স্বদেশভূমির নাম লালকালিতে জ্বলজ্বল করছে! কিন্তু আমি যে এলাম এক মাস আগে? লন্ডন থেকে মেহিকো গেলাম যে!
'সেটাই বুঝছি না,' অফিসারের জবাব। 'তবে আগের ইমিগ্রেশন অফিসার ভুল করেছে, আমি তো আর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারি না! তাই তুমি এই প্লেনে উঠতে পারবে না!'
ব্যস, পেটের ভিতরে একরাশ প্রজাপতি উড়ে গেল ফড়ফড় করে! ভ্রমণের শেষ গন্তব্য এই রিও নগরী, সব টাকাপয়সা শেষ, সাথের দুই বন্ধু এর মাঝে সেদিনই চলে গেল কোস্টারিকা! এখন কী হব!
জোর গলায় বললাম, 'এটা কী মামদোবাজি, আসলাম, আর যেতে দেবে না!'
তাদের এক কথা, 'আমরা অবশ্যই চাই তুমি যাও, কিন্তু এটা লন্ডনের বা বিলেতের নিয়ম, তুমি সেখানে বিনা ভিসা ট্রানজিটে গিয়ে কোনো ফষ্টিনষ্টি করলে আমরা ঝামেলার পড়ে যাব!'
এদিকে বিমানে একের পর এক যাত্রী উঠে যাচ্ছে! বিশাল বিমান ছিল, লাইনও দেখার মতো! দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই আলাদা হয়ে! এই ব্রাজিলের জন্য কত কান্না, অভিমান, হাসি। আর সেই দেশে এসেই অপমানিত হচ্ছি! মনে মনে তখন রীতিমতো ফুঁসছি।
অবশেষে আরেক অফিসার এসে বললেন, 'লন্ডনে ফোন করো। যদি রাজি না হয়, এই ছেলের সাথেও কথা বলাও, দেখ যদি ছাড় দেয়! আর একেবারে না দিলে পরের দিনের এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইটে তুলে দিও। ইউরোপের যেকোনো দেশ দিয়েই বাঙালিবাবু যেতে পারবে, কিন্তু যুক্তরাজ্য দিয়ে না!'
করা হলো ফোন। ইংরেজরা রাজি না। শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম, 'দাও তো, সমস্যাটা কী শুনি, মনে হচ্ছে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।'
ফোন নিয়ে জানতে চাইলাম, কী সমস্যা। ওই ইংরেজের প্রথম প্রশ্ন, 'তুমি তো শুনলাম লন্ডন হয়ে ফিনল্যান্ড যাবে, সেখানের ভিসা আছে?'
বললাম, 'ভিসা না থাকলে তারা ঢুকতে দেবে কেন! আমি থাকিই সেখানে, এত দিন পর্যন্ত ভিসা তো জ্বলজ্বল করছে পাসপোর্টে! এখানকার এরা বলছে তোমার দেশের মাটিতে এক ঢোক পানি খেলেও নাকি আমার ভিসা লাগবে। তো ২ ঘণ্টার ট্রানজিটে না হয় পানি পিপাসা চেপে রাখব, এবার আমাকে যাবার অনুমতি দাও। না হলে খামোখা পরে কোন দেশ দিয়ে আবার পাঠাবে, উটকো ঝামেলা! আমি ফিনল্যান্ডেই যাব, কোন চিন্তা কোরো না!'
আবার কী সব কথা বললেন তারা। তারপর অরিন্দম কহিল বিষাদে, ৩ ঘণ্টার বেশি আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে অবশেষে বিমান ওঠার ছাড়পত্র মিলেছিল।
এবার মেক্সিকোর গল্প।
সেবার দুই বছর ধরে মেক্সিকান বন্ধু ইয়াইয়াসের সঙ্গে নিরবচ্ছিন পত্র চালাচালি চলছিল ল্যাতিন আমেরিকার ভ্রমণের সব খুঁটিনাটি নিয়ে। সেইসঙ্গে মূল সমস্যা তৈরি করেছিল মেক্সিকান অ্যাম্বাসি—তারা জানাল ভিসা দিতে তাদের বিশেষ সমস্যা আছে, যেহেতু আমার পাসপোর্টটা খুব সন্দেহজনক ধরনের সবুজ! সেই সাথে জানাল যে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থাকলে মেক্সিকোর ভিসা লাগে না! কী আজব, আমেরিকা যাচ্ছি না তো, তাহলে তো তাদের অ্যাম্বাসিতেই যেতাম, যেতে চাইছি আমেরিকার চেয়ে অনেক অনেক গুণে বৈচিত্রময় দেশ মেক্সিকোতে।
আবার ফ্যাঁকড়া। প্রায় পনেরো ধরনের কাগজ চাইল। তার মধ্যে নিজের নাম যে পুলিশের কালো রেকর্ডে নথিবদ্ধ নেই তার প্রমাণ পর্যন্ত ছিল। এতেও শেষ নয়, নিজে উপস্থিত থেকে নাকি ভিসার জন্য নিয়মরক্ষার ইন্টারভিউও দিতে হবে। তাদের মহা ব্যস্ততার মাঝে অনেক ঝামেলা করে ২৮ ডিসেম্বর দুপুর এগারোটায় ২০ মিনিটের সময় দিল আমাকে। অথচ তার পরের দিনই যাত্রা শুরু, প্লেনের টিকেট কাটা আছে চর মাস আগে থেকে। কী মুশকিল! গেলাম সেখানে ব্যাকপ্যাক ভর্তি নিজের মেক্সিকোতে পালিয়ে না যাবার পক্ষের প্রমাণ নিয়ে (মেক্সিকোর উত্তর সীমান্তকে ব্যবহার করে কোটি কোটি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে, যে কারণে এত কড়াকড়ি)। সব দেখে দুই আঙুলের ছাপ নিয়ে রেটিনা স্ক্যান করানোর পর জানানো হল তারা আমাকে ভিসা দিতে অপারগ!
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়, আমি বরফের নিচে জমাট বাঁধা শোকের হিমালয় হয়ে গেলাম। অনেক কষ্টে কোঁকাতে কোঁকাতে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই জানাল, যেহেতু আমার বিমান টিকিটে লেখা আছে যাবার গন্তব্য মেক্সিকো সিটি, কিন্তু ইউরোপে ফিরে আসব ব্রাজিলের রিও থেকে, মানে অন্য দেশ থেকে, তাই তারা ভিসা ইস্যু করতে পারবে না! শেষমেশ অনেক নাটকের পরে ভিসা অফিসার মহিলা জানালেন, তাদের পক্ষে ৯০ দিনের জন্য ট্রানজিট ভিসা দেওয়া সম্ভব!
তখন আর কোনো রকম তর্কের সময় নেই, পরের দিন ফ্লাইট, তা-ই সই। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল গাড়িতে মেক্সিকো ভ্রমণের মাঝে আমাদের গুয়াতেমালা আর বেলিজ যাবার কথা পাকাপাকি হয়ে আছে, এখন ট্রানজিট ভিসা নিলে মেক্সিকো থেকে একবার বেরোলেই আবার প্রবেশের জন্য নতুন ভিসা নিতে হবে, আবার একই ফ্যাঁকড়া! আচ্ছা, পরেরটা পরে দেখা যাবে, এখনকার নগদটা নিয়ে নিই। এভাবেই শেষ হলো সেই মহাভিসা-রণ! অন্য দেশের ভিসা জোগাড়ের গল্প এর চেয়ে কম ঝামেলার নয়।
দিন দিন পাসপোর্টের মান কমছেই, অন্তত ভবিষ্যতের চিন্তা করে গঠনমূলক সব পলিসি নিলে বেশ কিছু দেশে ভিসা ফ্রি সুবিধা অদূর ভবিষ্যতেই করা সম্ভব। এবং সেটা উন্নয়নের বিশাল একটা সূচক।
কিন্তু করবে কে? কারা?