ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন কেন প্রায়ই ব্যাহত হয়?
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একমাত্র প্রধান সার্ভার ক্র্যাশ করে। কোনো ব্যাকআপ সার্ভার না থাকায় ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লেনদেন বন্ধ রাখতে হয় তাদেরকে।
দেশের প্রধান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র একটি ডাটা সেন্টারের মাধ্যমে তাদের বিশাল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অথচ ব্যাকআপ সার্ভার থাকলে মূল সার্ভার ক্র্যাশ করার সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার ট্রেডিং শুরু করতে পারতো ডিএসই। ব্যাকআপ সার্ভার মূলত একটি সেকেন্ডারি হার্ডওয়্যার যার কনফিগারেশন এবং ফাংশন প্রধান সার্ভারের মতোই।
নতুন একটি আপগ্রেডেড সার্ভার ব্যবহারের পরিবর্তে ডিএসই সেই পুরনো সার্ভার দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ঘন ঘন সমস্যা দেখা দিচ্ছে সার্ভারে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, ২০ কোটি টাকায় বেশ হাই কনফিগারেশনের ১২০টি ডেল সার্ভার সংগ্রহ করার পর এক বছরেও সেগুলো তারা ইন্সটল করেনি।
অন্যদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে নিজেদের ম্যাচিং ইঞ্জিন ও সার্ভেইলেন্স সিস্টেম ১০ বছরের জন্য ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ। ৩৭ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এ প্ল্যাটফর্মগুলো বিনামূল্যে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিলেও তাতে সাড়া দেয়নি ডিএসই।
৩৭ মিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের শর্তে ২০১৮ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে যোগ দেয় শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের চীনা কনসোর্টিয়াম।
বর্তমানে, ডিএসই নাসদাক-এর ম্যাচিং ইঞ্জিন এবং সফটওয়্যার বিক্রেতা ট্র্যাপেটস এর সার্ভেইলেন্স স্যুইট ব্যবহার করছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, এ সার্ভিসগুলোর জন্য বার্ষিক ৭ কোটি টাকা খরচ করতে হয় তাদেরকে। তবে নাসদাক ও ট্র্যাপেটস এর সাথে ডিএসই-র চুক্তি আগামী বছরই শেষ হবে।
অথচ শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রস্তাব গ্রহণ করে ডিএসই সহজেই টাকা বাঁচাতে পারত। শেনজেনের বিনামূল্যের সার্ভিস নিতে এবং প্রয়োজনীয় ইনস্টলেশনের কাজ করতেও ডিএসই-র দুই বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ, তাদের উচিত ছিল এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু করা।
নাসদাক ও ট্র্যাপেটসের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা আসলে কী করবে এ নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই, যা প্রতিষ্ঠানটির আইটি অবকাঠামোর দুর্বলতার প্রকাশ। এ থেকে আরো বোঝা যায়, বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিতে ফেলার পাশাপাশি তাদের এই দুর্বলতা সরকারের জন্যও আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসির সদস্য শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডিএসই-র প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও)কে ট্রেডিংয়ের ঘন ঘন বিভ্রাটের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বলা হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি। সে কারণেই সাম্প্রতিক ট্রেডিং বিঘ্নের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি, বলেন তিনি।
এদিকে ডিএসই বোর্ডের একজন প্রাক্তন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, নতুন হার্ডওয়্যার সেটআপ এবং চীনা কনসোর্টিয়ামের প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ব্যর্থতা আদতে ডিএসই-র ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা।
ডিএসই কর্তৃক বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা জিয়াউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নাসদাকের প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ট্রেডিং বিঘ্নিত হয়েছে। "এ বিষয়ে ইতোমধ্যে নাসদাককে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে," বলেন তিনি।
ডাটা সেন্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমরা ২০১৬ সাল থেকে একটি ব্যাকআপ সার্ভার স্থাপনের চেষ্টা করছি। ২০২১ সালে এটি অনুমোদন করে বোর্ড। এর কাজ চলছে।"
শেনজেনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
২৪ অক্টোবর তিন ঘণ্টা লেনদেন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ডিএসইতে দৈনিক লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকার দৈনিক গড় থেকে ৩৩৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। প্রতি ১০০০ টাকার ট্রেডিংয়ে ডিএসই পায় ২৫ পয়সা, সরকার পায় ৫০ পয়সা।
লেনদেন বিঘ্নিত হওয়ায় তাদের টার্নওভারে ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লেনদেন বন্ধের কারণে ডিএসইর বিশ্বব্যাপী সুনামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর মাত্র ৬ দিন পর (৩০ অক্টোবর) প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে আবারো ডিএসই-র ট্রেডিং ব্যাহত হয়। এদিন ট্রেডিং সেশন শুরু হতে দেড় ঘণ্টা বিলম্ব হয়।
ডিএসই একটি নোটিশে ব্যাখ্যা করে, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে এ সমস্যা হয়নি; বরং তা ছিল একটি হিউম্যান এরর। ৭০টি স্টকের উপরে সার্কিট ব্রেকারের নির্দেশনা দেওয়ার ফলে এটি হয়েছে বলে উল্লেখ করে তারা।
এর আগে, প্রতিষ্ঠানটির আইটি বিনিয়োগে অনিয়মের জন্য এর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা এবং আইসিটির মহাব্যবস্থাপককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন ডিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক আমিন ভূঁইয়া। আইটি বিভাগের সাথে মতবিরোধের কারণে এক মাস আগে পদত্যাগ করেন তিনি।
তারেক আমিন ভূঁইয়ার লেখা একটি আট পৃষ্ঠার নোটিশে তিনি বর্ণণা করেন, কীভাবে আইটি কর্মকর্তাদের একটি অংশের দুর্নীতির ফলে দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে ভগ্নাবস্থায় রয়েছে ডিএসই।
টিবিএস-এর প্রাপ্ত এ নোটিশ তিনি পদত্যাগের ঠিক আগে আগস্ট মাসে লিখেছেন।
কারণ দর্শানোর এ নোটিশে তারেক আমিন প্রশ্ন তোলেন, অন্যান্য বিক্রেতাকে ছাপিয়ে আইসিটি বিভাগ কেন শুধুমাত্র ওয়ানওয়ার্ল্ড ইনফোটেক-কে গুরুত্ব দিচ্ছে, যেখানে অন্যান্য বিনিয়োগগুলোর প্রস্তাবনায় ডাটা সেন্টার টাওয়ার প্রকল্পেরও উল্লেখ আছে।
তবে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার নিয়ে অনিয়ম, আইটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ডিএসই টাওয়ার ডেটা সেন্টার প্রকল্প নিয়ে তার নোটিশে উত্থাপিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি বোর্ড।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কারণ দর্শানোর এ নোটিশটি পরে আপিল বোর্ডে নেওয়া হয়, এবং এমডির পদত্যাগের পর তা খারিজ করে দেওয়া হয়।
তারেক আমিনের পদত্যাগের পর গত এক মাস ধরে এমডি ছাড়াই চলছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।
ডিএসই বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, কারণ দর্শানোর নোটিশের বিষয়ে তাকে অবহিত করা হয়েছে, কিন্তু এ নোটিশে উত্থাপিত বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত নন।
"আমি এটাও শুনেছি যে আপিল বোর্ডে কারণ দর্শানোর নোটিশ উপস্থাপন করা হয়েছিল, তবে আমি এ বিষয়ের আপডেট জানি না," বলেন তিনি।
ইউনুসুর রহমান বলেন, ডিএসই সার্ভারে ঘন ঘন ট্রেডিং বিঘ্নের জন্য প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, "আইটি বিভাগ বলেছে সর্বশেষ ট্রেডিং বিঘ্ন ঘটেছে মানবসৃষ্ট কারণে। তবে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত নই।"
"তাদের থেকে উত্তর পাওয়ার পর আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারব। সেইসাথে সাবেক এমডির কারণ দর্শানোর নোটিশে উত্থাপিত বিষয়গুলোও আলোচনা করা হবে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে দুইবার ট্রেডিং বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সোমবার (৩১ অক্টোবর) ডিএসইর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মো. জিয়াউল করিমকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর আদেশ জারি করে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
২৪ ও ৩০ অক্টোবর ডিএসই-র ট্রেডিং ত্রুটির কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা না দেওয়া পর্যন্ত তিনি ছুটিতে থাকবেন।
ডিএসই ডিমিউচুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট ২০১৩ শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রককে এ ক্ষমতা দিয়েছে যে, তারা এ আইনের লক্ষ্য অর্জনে তাদের আওতাধীন যেকোন সত্তাকে (ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠান) যেকোনকিছু করার আদেশ দিতে পারে। কিন্তু বিএসইসি নিজেই প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটির নির্দেশ দিয়েছে।
আইটি বিভাগের একটি সিন্ডিকেট যেভাবে ডিএসইকে দুর্বল করে দিয়েছে
আইটি প্রকল্প বাস্তবায়নসহ অন্যান্য বিক্রেতার সকল প্রযুক্তি বিনিয়োগকে ছাপিয়ে শুধুমাত্র ওয়ানওয়ার্ল্ড ইনফোটেক (ওবিআই)-কে গুরুত্ব দিয়েছে ডিএসই।
তারেক আমিন তার কারণ দর্শানোর নোটিশে বলেছিলেন, একটি কোম্পানির সব প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মের জন্য একটি নির্দিষ্ট বিক্রেতার উপর নির্ভর করা খুবই বিপজ্জনক। সেই বিক্রেতা যদি হঠাৎ করেই কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তাহলে ডিএসইর আর কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা থাকবে না।
তিনি লিখেন, "বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি কোম্পানির প্রধান তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা সেই কোম্পানির প্রধান তথ্য/প্রযুক্তি কর্মকর্তার কাছে সবকিছু রিপোর্ট না করার যথেষ্ট কারণ থাকে; এবং এটাই স্বাভাবিক প্র্যাক্টিস। ঠিক একইভাবে, কোম্পানির প্রোডাকশন ডাটা সেন্টার এবং সকল সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও সাপোর্টের ভার কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট বিক্রেতাকে না দেওয়াও স্বাভাবিক প্র্যাক্টিসের মধ্যেই পড়ে। যদি সেই বিক্রেতার বাজে কোনো উদ্দেশ্য থাকে, বা যদি এর অস্তিত্বই না থাকে, তাহলে কোম্পানির আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাও থাকতে পারে।"
"ডিএসই-র মূল ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা, সাপোর্ট এবং প্রায় সমস্ত সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ক কাজের ভার ওয়ানওয়ার্ল্ড ইনফোটেককে প্রদান করে আমরা ইতোমধ্যেই ডিএসই-র জন্য একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছি।"
ডেটা সেন্টার টাওয়ার বাস্তবায়নে বিলম্ব
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সমস্ত ব্যাংকের ব্যাকআপ সার্ভার থাকলেও ডিএসই কেবল একটি ডেটা সেন্টার দিয়ে চলছে।
নিকুঞ্জের ডিএসটি টাওয়ারে অফিস স্থানান্তর করার পর মূল ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ডিএসই। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পটির সময়সীমা দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে।
ডিএসই-র প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাই ডাটা সেন্টার প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান।
বর্তমানে মতিঝিলের পুরনো ডাটা সেন্টার ব্যবহার করছে তারা। ঢাকা মহানগরীর আবদুল মোনেম টাওয়ারের চতুর্থ তলায় দ্বিতীয় ডাটা ব্যাকআপ সার্ভার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর কাজ এখনও শুরু হয়নি।
তবে ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে টাওয়ারের ফ্লোরের জন্য তারা সাড়ে চার লাখ টাকা করে ভাড়া দিয়ে আসছে।