ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ, দায় কার?
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নিয়মিত মশা নিধন অভিযানসহ আপাতদৃষ্টিতে নানান ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে, তা সত্ত্বেও ঢাকায় এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ স্মরণকালের ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করছে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, দেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর ৬০ শতাংশেরও বেশি রাজধানী ঢাকাতে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এডিস মশার প্রজনন স্থল (লার্ভা) ধ্বংস করতে চিরুনি অভিযানসহ তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
নগরীতে মশা জন্মানোর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে জরিমানাও করা হয়েছে।
তবে সিটি কর্পোরেশনের সকল প্রচেষ্টাই নিছক লোক দেখানো হওয়ায় ডেঙ্গু থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেকের।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সব এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটানো, ফগিং-এর সময় গলির মধ্যে না গিয়ে মেইন রাস্তায় ফগিং করাসহ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায়, ডোবা-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম কোনো কাজে আসাছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পশ্চিম কাফরুল এলাকার বাসিন্দা শারমিন ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "এলাকার এমন কোনো বাসা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ডেঙ্গু রোগী নেই। সিটি কর্পোরেশনের মশক কর্মীরা মাসে ২/১ বার মেইন রাস্তাতে ফগিং করলেও গলির মধ্যে তাদের দেখা যায় না।"
এদিকে, উভয় সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাই পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন।
অসময়ে বৃষ্টির কারণে এডিস মশার বিস্তার বেড়েছে এবং ঢাকার রোগীদের একটি বড় অংশ অন্য জেলা থেকে এসেছেন বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।
প্রতিবছরই এডিস মশার সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৪৫.৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সিনিয়র ইন্সেক্ট কন্ট্রোল অফিসার মোঃ আসিফ ইকবাল টিবিএসকে বলেন, "আমরা সকালে টেমেফস কীটনাশক লার্ভিসাইড এবং সন্ধ্যায় ম্যালাথিয়ন ৫ইসি ফগিং করি। প্রায় ৩ বছর ধরে এটিই ব্যবহার করছি। প্রতি সপ্তাহে দুদিন একই এলাকায় ফগিং ও লার্ভিসাইড করে মশক কর্মীরা। উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন মশক নিধন কর্মী ও দুই জন করে সুপারভাইজার কাজ করছেন।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জোবায়দুর রহমান বলেন, "আমরা ওয়াসার মিটারে ট্যাবলেট মেশাচ্ছি যাতে তিন মাস সেখানে কোনো এডিস মশা জন্মাতে না পারে।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ ফজলে শামসুল কবির বলেন, "মশক কর্মীরা ৪ দিন পর পর একই এলাকায় নিয়মিত এ কার্যক্রম চালায়। দক্ষিণ সিটির প্রতিটি ওয়ার্ডে ১৩ জন মশককর্মী ও ১ জন সুপারভাইজারসহ ৭৫ টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৫০ জন কাজ করছে মশা নিয়ন্ত্রণে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করা গেলে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আকনা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এরমধ্যে যদি আবার বৃষ্টি হয় তাহলে ডেঙ্গু আবার বাড়বে।"
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, "সারা বছরই সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা চালু রাখতে হবে। এজন্য যেমন লোকবল বাড়াতে হবে, তেমনি অভিজ্ঞ লোকদের সমন্বয়ে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ বি-নাজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "একই কীটনাশক বেশিদিন ব্যবহার করলে মশার কাছে তা সহনীয় হয়ে যায়। এজন্য কীটনাশক ব্যবহারে নিয়মিত পরীক্ষা করা দরকার।"
দেশের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা ছাড়া বাকি ৬২ জেলাতেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মাদারীপুর, কুমিল্লা ও গাজীপুরে।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হলো ১৮২। এটি দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (১১ নভেম্বর) সকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৬৬ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকায় ১৫০ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১৬ জন রোগী রয়েছেন।
চলতি নভেম্বরের প্রথম ১১ দিনে ৮ হাজার ৭২৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং একই সময়ে মারা গেছেন ৫২ জন।