ঢাকাতে কি আরো আধুনিক পাবলিক টয়লেট থাকা সম্ভব?
- রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট আছে- ১৫৮ টি
- ঢাকা উত্তর সিটি ৬৭টির মধ্যে ব্যবহৃত হয় ৬৪টি
- ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৯১টির মধ্যে ব্যবহৃত হয় ৫৮টি
- অধিকাংশ পাবলিক টয়লেট প্রয়োজনস্থলে বানানো হয়নি
- নিম্নআয়ের এবং ভবঘুরেরা টাকা দিয়ে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক
প্রায় দুই কোটিরও বেশি জনসংখ্যার রাজধানী শহর ঢাকাতে এখনও অন্যতম এক প্রধান সমস্যা পাবলিক টয়লেটের সংকট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে নগরে পাবলিক টয়লেট সংকটের কারণে 'প্রাকৃতিক কাজে' নগরবাসীর পোহাতে হয় বিড়ম্বনা।
সম্প্রতি ওয়াটারএইড এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার সড়কপথে প্রতিদিন চলাচল করা ৫০ লাখ মানুষের জন্য পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা মাত্র ৪৯টি এবং সেগুলোর অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী।
বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতায় পাবলিক টয়লেট রয়েছে ১৫৮টি এবং এগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত হয় ১২২টি; যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পাবলিক টয়লেটগুলো বিভিন্ন এনজিও ও ইজারার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া হয় পরিচালনার জন্য। এসব পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে নগরবাসীকে খরচ করতে হয় ৫ থেকে ১০ টাকা। কিন্তু নিম্ন আয়ের এবং ভবঘুরে ব্যক্তিরা টাকা খরচ করে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে চান না।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন বাস স্টপেজ, মার্কেট, পার্কিং এরিয়াসহ যেসব স্থানে মানুষের বেশি প্রয়োজন সেসকল স্থানে পাবলিক টয়লেট সংখ্যা খুবই কম। আবর অনেক স্থানে টয়লেট থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। এ কারণে যাত্রাপথে টয়লেটের প্রয়োজন হলে বেশি বিপদে পড়েন নারীরা।
পাবলিক টয়লেট সংকটের কারণে নারীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে টয়লেট চেপে রাখা এবং বাইরে থাকলে কিছু না খাওয়া, বিশেষ করে পানি পান না করার প্রবণতা দেখা যায়। এভাবে দীর্ঘসময় চেপে রাখার ফলে নারীরা নানা রকম শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়েন।
চিকিৎসকরা বলছেন, কেবল নারীরা নন, একই সমস্যার জন্য পুরুষেরাও ভুগেন মূত্রনালিতে সংক্রমণসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরীবাগ এলাকার রাস্তার পাশেই প্রাকৃতিক কাজ সাড়ছিলেন এক পথচারী। তিনি টিবিএসকে বলেন, "প্রাকৃতিক কাজ সাড়ার জায়গা না থাকলে তো রাস্তার পাশে, আড়ালেই করতে হবে। এতক্ষণ যানজটে বসে ছিলাম, এখানে নেমে কোনো পাবলিক টয়লেট না পেয়ে রাস্তার পাশেই কাজ সাড়তে হয় আমাকে।"
উত্তর সিটির বিজয়স্মরণী মোড়ে পাবলিক টয়লেট খুঁজছিলেন সায়মা ইসলাম। তিনি টিবিএসকে বলেন, "এ শহর নারীবান্ধব নয়। একদিকে যানজটের কারণে বাসের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়; আবার প্রয়োজনস্থলে পাই না কোনো পাবলিক টয়লেট। অনেক খুঁজে না পেয়ে শেষে একটি দোকানের মালিককে অনুরোধ করে তাদের টয়লেট ব্যবহার করেছি।"
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সম্প্রতি ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি শৌচাগার নির্মাণ করেছে। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ মানুষ এটি ব্যবহার করতে পারেন।
ফার্মগেটের এই পাবলিক টয়লেট ব্যবহারকারী রওশন আরা টিবিএসকে বলেন, "এটা আমাদের জন্য একটা সুবিধা যে এখানে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। টয়লেটটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও। ৫টাকা খরচ করে ব্যবহার করা যায় এ টয়লেট।"
ঢাকা দক্ষিণের পান্থপথ এলাকায় একই সুযোগ সুবিধা নিয়ে আরেকটি পাবলিক টয়লেট রয়েছে।
এ পাবলিক টয়লেট ব্যবহারকারী সুলতান আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "এখানে এত সুন্দর পাবলিক টয়লেট আছে জানতাম না। সব বাসস্ট্যান্ডে যদি এমন টয়লেট পাওয়া যেত! ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থেকে টয়লেটে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।"
তিনি আরো বলেন, "ঢাকার কিছু জায়গায় ভালো মানের পাবলিক টয়লেট আছে কিন্তু বাকিগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সিটি করপোরেশন যদি এসব টয়লেট ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে তাহলে মানুষ টাকা খরচ করেও সেগুলো ব্যবহার করবে।"
অনেকেই টিবিএসকে বলেছে যে তারা এমন পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন যেগুলো পরিষ্কার এবং যেগুলোতে পুরুষ- নারীদের জন্য আলাদা চেম্বার রয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৬.২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৫৪ ওয়ার্ডের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ৬৭ টি, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবহার হচ্ছে না।
অন্যদিকে ১০৯.২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৭৫ ওয়ার্ডের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ৯১টি যার মধ্যে ৩০টিরও বেশি ব্যবহার হচ্ছে না।
সরেজমিনে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ স্থানেই নেই কোনো পাবলিক টয়লেট। ফলে রাস্তার পাশে, ফুটপাত, গাছের আড়ালে, এমনকি ফুটপাতেই প্রাকৃতিক কাজ সাড়েন নগরবাসী।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মালিকানাধীন পাবলিক টয়লেট থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ ব্যবহারের উপযোগী নয়। একদিকে পরিচ্ছন্নতার অভাব অন্যদিকে নারী ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী নয় এসব টয়লেট।
সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ পাবলিক টয়লেটই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থেকে বেশ দূরে হওয়ায় সেগুলো প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছে না পথচারীরা। যদিও সিটি করপোরেশনের এসব পাবলিক টয়লেটগুলোতে নারী-পুরুষ-প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।
পাবলিক টয়লেটর সমস্যা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ওয়াটারএইড বাংলাদেশ প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে 'মেকিং দ্য পাবলিক টয়লেট ওয়ার্ক' থিমে পদক্ষেপ নেয়। তারা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এ পর্যন্ত ৩২টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে 'ভূমিজ' পাবলিক টয়লেটগুলো নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে।
ব্র্যাকের সহযোগিতায় ২০১৭ সালে রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে নারীদের জন্য দেশের প্রথম পাবলিক টয়লেট নির্মাণের মাধ্যমে ভূমিজ যাত্রা শুরু করে।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান টিবিএসকে বলেন, "ঢাকাতে যে পরিমাণে যানজট সমস্যা বাড়ছে তাতে মানুষকে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হয়। কিন্তু এই সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা অনেক কম। আবার যেগুলো আছে তার মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহার উপযোগী না। এজন্য সবারই স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়।"
তিনি বলেন, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ এবং মেইন্টেইনের ক্ষেত্রে দুই সিটি মেয়রের সদিচ্ছার অভাব নেই; কিন্তু এর সাথে যুক্ত থাকা কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ঢাকাতে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ বিভিন্ন সিগনাল, বাস স্টপেজগুলোতে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ শামীম টিবিএসকে বলেন, "প্রাকৃতিক কাজ সময়মত না সাড়ার ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মূত্রনালির সংক্রমণে। এমনকি এর ফলে নারীর প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।"
"এছাড়া মল-মূত্র বেশিক্ষণ চেপে রাখার কারণে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে কিডনি স্টোন বা পাথর তৈরি করতে পারে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে ইদানীং এ রোগে আক্রান্ত হবার হার বাড়ছে," বলেন তিনি।
রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব মূলত দুই সিটি করপোরেশনের। পাবলিক টয়লেটের সংস্কার ও পরিচালনা বাবদ যাবতীয় ব্যয় সিটি করপোরেশন নিজস্ব তহবিল অথবা যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বহন করবে অথবা কোনো দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক এনজিও, বিভিন্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অন্য কোনো বৈধ উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির তহবিলের মাধ্যমে করার কথা।
কিন্তু দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকটি পাবলিক টয়লেটই নির্মাণের পর তা ইজারাদারদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, ফলে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় ব্যবহারকারীদের থেকে। উত্তর সিটির ৬৪টি পাবলিক টয়লেটই বিভিন্ন এনজিও'র মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানেও অন্য টয়লেটগুলোর মতো টাকা নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাজেট ধরেছে মাত্র ১.৫০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে উত্তর সিটি এক টাকাও ব্যয় করেনি এ খাতে।
অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গত অর্থবছরে পাবলিক টয়লেট নির্মাণে ব্যয় করেছে মাত্র ৪৫ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এ খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ৩ কোটি টাকা।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন জানায়, দুই সিটি চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে টয়লেট নির্মাণ করছে। তবে কিছু স্থানে জমি সংকট থাকার কারণে প্রয়োজন থাকলেও নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্ব টয়লেট দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০১ সালে সারা বিশ্বে টয়লেট ব্যবহার ও স্যানিটাইজেশন সম্পর্কে ক্যাম্পেইন শুরু করে ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজেশন। এরপর থেকে প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব টয়লেট দিবস।