হ্যাকারদের হাতে এক সপ্তাহের বেশি জিম্মি প্যাসিফিকের দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু
সাইবার আক্রমণের শিকার হয়ে ১১ দিনের বেশি অফলাইনে আছে দ্বীপদেশ ভানুয়াতুর সরকার। খবর বিবিসির।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটির সংসদ, পুলিশ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে।
হ্যাক করা হয় ভানুয়াতু সরকারের ইমেইল সিস্টেম, ইন্ট্রানেট ও স্কুল, হাসপাতালসহ অন্যান্য জরুরি সেবার ডাটাবেজও। এমনকি সমস্ত সরকারি সেবা ও বিভাগও হ্যাক করা হয়।
শাটডাউনের ফলে ৩ লাখ ১৫ হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে কর পরিশোধ, ইনভয়েসিং বিল করা এবং লাইসেন্স ও ভ্রমণ ভিসা দেওয়ার মতো মৌলিক সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এর ফলে সরকারি কাজ করতে হয় ম্যানুয়ালি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক সরকারি দপ্তর বন্ধই করে দেওয়া হয়।
এর মাঝেই সরকারি কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ইমেইল ও ইন্টারনেট হটস্পট ব্যবহার করে অত্যাবশ্যকীয় কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এ সময় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় কোনো আর্থিক লেনদেন করা হয়নি, মানুষকে চেক দেওয়া হয়েছে। একজন কর্মচারী বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরে চেক ও বিভিন্ন আবেদনপত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এনেছেন। বাকিরা ম্যানুয়ালি নোট নিয়েছেন।
কী হয়েছিল?
কয়েকজন সরকারি কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে বিবিসিকে জানান, খুব সম্ভব গত ৪ নভেম্বর সরকারের সবগুলো সার্ভার দখল করে নেয় হ্যাকাররা।
কোথাও যে একটা ঝামেলা হয়েছে, তা প্রথম বোঝা গিয়েছিল সরকারি অ্যাড্রেসে পাঠানো ইমেইল পাঠানো যাচ্ছে না এটা দেখে।
সরকারি সমস্ত ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিপিং, বিমানের ফ্লাইট, স্বাস্থ্যসেবাসহ আরও অনেক খাত।
ধারণা করা হয়, অর্থের জন্য ভানুয়াতু সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছিল। অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্র দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, আক্রমণকারীরা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। কিন্তু ভানুয়াতু সরকার তা দিতে রাজি হয়নি।
হ্যাকার কারা ছিল, তারা কত টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল—এসব তথ্যের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।
সাইবার আক্রমণটাই বা কীভাবে করা হয়েছিল, তা-ও জানানো হয়নি।
ভানুয়াতু ইতিমধ্যে তাদের সিস্টেম উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নেটওয়ার্ক নতুন করে গড়তে প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার কাছে সাহায্যও চেয়েছে।
ভানুয়াতুকে কেন টার্গেট করা হলো?
ভানুয়াতুতে নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে এই আক্রমণ এল। তবে নতুন সরকার হ্যাকারদের মুক্তিপণের দাবিতে রাজি হয়নি বলে জানান সিডনিভিত্তিক লোয়ি ইন্সটিটিউটের প্যাসিফিক আইল্যান্ড প্রোগ্রামের পরিচালক ড. মেগ কিন।
তিনি বলেন, 'আক্রমণটার পেছনে কে আছে, তা আমরা এখনও জানি না। তবে সরকারের একজন মুখপাত্র ইঙ্গিত দিয়েছেন, আক্রমণটা এসেছে বাইরে থেকে, সম্ভবত এশিয়া অঞ্চল থেকে।'
কারও কারও ধারণা, হ্যাক করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ভানুয়াতু দীর্ঘদিন ধরে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম পাপুয়া প্রদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। পশ্চিম পাপুয়ার অধিকাংশ মানুষ মেলানেশিয়ান।
অন্যরা প্যাসিফিক অঞ্চলে ভানুয়াতুর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সম্পর্ক রয়েছে।
এ বছর ওয়াশিংটন ও বেইজিং উভয়েই ভানুয়াতুর প্রতি আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়েছে। দ্বীপরাষ্ট্রটির নেতাদের গত সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অন্যদিকে গত জুনে একটি আঞ্চলিক চুক্তি করার জন্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাসিফিক সফরে যান।
গত কয়েক বছরে বেইজিংয়ের অন্যতম ঘনিষ্ঠ প্যাসিফিক দ্বীপ হয়ে উঠেছে ভানুয়াতু। চীনা বিনিয়োগে দেশটির সংসদ ভবন, স্পোর্টিং স্টেডিয়াম ও কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ভানুয়াতুর পোর্ট ভিলায় বেইজিংয়ের দূতাবাস আছে। অন্যদিকে ভানুয়াতুতে ওয়াশিংটনের নিকটতম প্রতিনিধি পাপুয়া নিউ গিনিতে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অস্ট্রেলিয়া চার দশকের বেশি সময় ধরে ভানুয়াতুর সবচেয়ে বড় দাতা সহযোগী এবং নিকটতম নিরাপত্তা অংশীদার।
গত বছরই প্যাসিফিক অঞ্চলের টেলিকম কোম্পানি ডিজিসেল কিনতে নিতে টেলিকম জায়ান্ট টেলস্ট্রাকে অর্থায়ন করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। কাজটি করা হয়েছে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে।
গুজব ছিল, ডিজিসেল তাদের প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যবসা চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন অপারেটর চায়না মোবাইলের কাছে বেচে দিতে পারে।
ড. কিন বলেন, ভানুয়াতুও অন্যান্য দেশের মতো সরকারি তথ্যকে সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু দেশটির সামর্থ্য সীমিত। ভানুয়াতুর অর্থনীতি অনেকাংশেই কৃষি ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির ইন্টারনেট সিস্টেমও দুর্বল।
সব মিলিয়ে এসব কারণেই মূলত ভানুয়াতুকে সাইবার আক্রমণের টার্গেট করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।