আরব বসন্ত ও এশিয়ান ফুটবলের দাপট
ফুটবল বিশ্বকাপের ৯২ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। দীর্ঘ এই সময়ে ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরে শাসন করে গেছে কেবল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোই। সবগুলো আসরেই সেরার মুকুট উঠেছে এই দুই অঞ্চলের কোনো দলের মাথায়। দুই-একটা অঘটন বাদ দিলে ফুটবল বিশ্বকাপে এশিয়ার বলার মতো তেমন কিছুই নেই।
২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সেই স্বপ্নের পথচলা বাদ দিলে বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো দলই সেভাবে দাপট দেখাতে পারেনি কখনও। সেখানে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন এখনও দূর আকাশের তারা। বিশ্বকাপ জিততে পারে এশিয়ার কোনো দেশ, এমন আলোচনা কখনও হয়ওনি। শক্তি-সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা, সাফল্য বিবেচনায় ব্যাপারটা এমন যে, বিশ্বকাপ জয়ের কথা মুখে আনাটাই বাড়াবাড়ি।
এবার এশিয়াতে বসেছে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে কাতার। এবারের আসরেও এশিয়ার কোনো দেশকে নিয়ে সেভাবে হাঁকডাক ছিল না। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতেই শোরগোল অবস্থা। এশিয়ান ফুটবলের দাপটের মাঝে আরব বসন্ত সুগন্ধী সব ফুল ফোটাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে কয়টি অঘটন ঘটেছে, সবগুলোই এশিয়ার দেশগুলোর।
এবারের বিশ্বকাপে এশিয়া অঞ্চলের ৬টি দেশ অংশ নিয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও কাতার। আরব অঞ্চল থেকে খেলছে ৪টি দেশ। আয়োজক দেশ হিসেবে খেলছে কাতার, এশিয়ার আরেক আরব দেশ সৌদি আরব। আফ্রিকার দুই দেশ তিউনিশিয়া ও মরক্কোও আরব অঞ্চলের। সব মিলিয়ে এশিয়া ও আরব অঞ্চল থেকে ৮টি দেশ এবার বিশ্বমঞ্চে লড়ছে।
এই ৮ দলের মধ্যে কাতার ও ইরান চমক না দেখাতে পারলেও বিস্ময়কর পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে সৌদি আরব ও জাপান। চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে তিউনিশিয়া ও মরক্কোও। অঘটনের শুরু সৌদি আরবকে দিয়ে। ঘোষণা দিয়ে আর্জেন্টিাকে চমকে দিয়েছে দেশটি। তাদের কোচ হার্ভে রেনার্ড ম্যাচের আগে বলেন, অবিশ্বাস্য কিছু করে মেসিদের চমকে দিতে চান তারা। কথামতোই কাজ, আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।
একই দিনে চমক জাগানিয়া পারফরম্যান্স করে তিউনিশিয়া। এবারের আসরের অন্যতম সেরা দল হিসেবে বিবেচিত ডেনমার্কের বিপক্ষে দারুণ লড়াই করে গোলশূন্য ড্র করে আরব অঞ্চলের দেশটি। একই রাতে দারুণ শুরু করে অস্ট্রেলিয়াও। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের জালে তারাই প্রথম বল পাঠায়। যদিও শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেনি অজিরা, ম্যাচ হারে ৪-১ গোলের বড় ব্যবধানে।
পরের দিন আবারও আরব বসস্ত, এবার মরক্কোর দাপট। বিশ্বকাপের বর্তমান রানার্স-আপ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে অসাধারণ ফুটবল খেলে তারা। ফিনিশিংয়ের অভাবে গোল দিতে না পারলেও নিজেদের জাল অক্ষত রাখে তারা। শক্তিতে বেশ এগিয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ে মরক্কো।
এরপর আরেকটি বড় অঘটন, এবার শিকার চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। সূর্যদয়ের দেশ জাপানের চোখ ধাঁধানো ফুটবলে উদিত হয় নতুন সূর্য। প্রথমে পিছিয়ে পড়া জাপান প্রথমার্ধও শেষ করে ১-০ গোলের ব্যবধানে। তারাই শেষ সময়ে গিয়ে লেখে রূপকথার গল্প। ৮ মিনিটের ব্যবধানে জার্মানির জালে দুবার বল পাঠিয়ে তুলে নেয় ২-১ গোলের মহাক্যাবিক এক জয়। যা বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য এবং বিশ্ব আসরের বড় অঘটনগুলোর মধ্যে একটি।
অথচ এতো সাফল্যের গল্প লেখা দলগুলোর বিশ্বকাপ অতীতই কিনা সাদামাটা। এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সাফল্য দক্ষিণ কোরিয়ার। ঘরের মাঠের সেই বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে খেলে তারা। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। কোরিয়া ছাড়া এশিয়ার আর কোনো দল বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড বা শেষ ষোলোর বাধা ডিঙাতে পারেনি।
২০০২ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের সেই হারের শোধ ১৬ বছর পরে এসে নেয় কোরিয়া। ২০১৮ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে শক্তিধর জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে দেয় তারা। এই হারে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় জার্মানিকে। তারকায় ঠাসা জার্মানির ওই হারও ছিল বিশ্বকাপের বড় অঘটনের একটি। আজ উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করতে যাওয়া দক্ষিণ কোরিয়া দিকে এবারও অনেকে তাকিয়ে। তারা চমকে দেওয়া পারফরম্যান্স করতে পারলে আরব বসন্তের পর এশিয়ার ফুটবলেও লাগবে রোমাঞ্চের হাওয়া।