দু’বছরে বন্ধ ২৫ কারখানা, মহামারির লোকসানের বোঝায় কাহিল অ্যালুমিনিয়াম শিল্প
১৯৯০ সালের পর চট্টগ্রামের মোহাম্মদপুর অ্যালুমিনিয়াম গলিতে তৈজসপত্রের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন শেখ ইউনুছ মিয়া। ছোট দোকান থেকে 'মেসার্স ইউনুছ অ্যান্ড ব্রাদার্স' নামে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এরপর তার হাত ধরে ভাই শেখ হাতেম মিয়াও প্রতিষ্ঠা করেন হাতেম অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস। রোলিং মিল থেকে অ্যালুমিনিয়াম সার্কেল সংগ্রহ করে স্পিনার মেশিনে ১০-১২ রকমের তৈজসপত্র উৎপাদন হতো কারখানা দু'টিতে। করোনা মহামারিতে লোকসানের ভারে টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান দুটি।
শেখ ইউনুছ মিয়ার ছেলে আমিনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের দীর্ঘ ৩৫ বছরের ব্যবসা এখানে। কোভিডে দু'বছরে কারখানা আট মাস বন্ধ ছিল। অনেক লোকসান হয়েছে। পাইকারি ক্রেতাদের কাছে আটকে থাকা টাকা তুলতে পারিনি। পুঁজির অভাবে উৎপাদন কমে যায়। ৭০০ কেজি থেকে ১০০ কেজিতে নেমে আসে দৈনিক উৎপাদন। ২০২১ সালের এপ্রিলে করোনায় বাবা মারা গেছেন। লোকসান টানতে না পেরে ডিসেম্বরে কারখানা বন্ধ করি।"
করোনা মহামারির লোকসানের ভার বহন করতে না পেরে গত দুই বছরে মেসার্স ইউনুছ অ্যান্ড ব্রাদার্স, হাতেম অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কসের মতো ছোট-বড় অন্তত ২৫টি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিক মজুরি-কারখানার ভাড়া বহন, কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধি, বাজারে থাকা পাওনা তুলতে না পেরে বেশিরভাগ কারখানা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়।
নব্বই দশকের দিকে মাটির তৈজসপত্রের বাজার ছাপিয়ে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের উত্থান ঘটে। তখন চট্টগ্রামের মোহাম্মদপুর অ্যালুমিনিয়াম গলিতে গড়ে ওঠে অনেক কারখানা। এখানে উৎপাদিত হতো পাড়ি-পাতিল, কলসি, ডেক, কড়াই, বালতি, গামলা, সসপেন, ঢাকনা, টিফিন ক্যারিয়ার, পানের বাটাসহ ২০ রকমের পণ্য। তবে অ্যালুমিনিয়ামের পাশাপাশি প্লাস্টিক, মেলামাইন ও এসএস স্টিলের প্রচলন বাড়ায় এসব পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমতে শুরু করে ২০১০ সালের পর। দামেও প্রতিযোগিতা করা কঠিন ছিল। সংশ্লিষ্টদের মতে, শিল্পটি বর্তমানে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। নানামুখী সংকটে উৎপাদনের চাকা ঘুরাতেই হিমশিম।
চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে ৩৩টি উৎপাদনমুখী কারখানায় দৈনিক ৮ টন পণ্য উৎপাদন হতো। তখন প্রায় ১২০০ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। ২০০০ সালে মোট ৬০টি কারখানায় প্রায় ১০ টন পণ্য উৎপাদন হতো। কর্মসংস্থান বেড়ে দাঁড়ায় দেড় হাজারে। ২০১০ সালে মোট ১০০টি কারখানায় প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের হাতে ১৫ টন পণ্য উৎপাদন হতো। বর্তমানে শিল্প কারখানার সংখ্যা ৭০টিতে নেমেছে। তখন দৈনিক উৎপাদন ছিল ১৩ টন। কর্মসংস্থান আগের মতো দুই হাজার ছিল।
অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের কাঁচামালের ৫০ শতাংশ ইংগোট। অ্যালুমিনিয়ামের পুরাতন পণ্য, জাহাজের স্ক্র্যাপ, ফয়েল পেপার, ওষুধ বর্জ্য, ড্রিংকসের ক্যান, বোতলের ঢাকনা মিলে বাকি ৫০ শতাংশ। দুই বছরে ইংগোটের দাম প্রতি কেজি ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৪০ টাকায় পৌঁছেছে। পুনর্ব্যবহার যোগ্য কাঁচামালের সংকটও রয়েছে। বেড়েছে শ্রমিকের মজুরিও। আগে প্রতি কেজি পণ্যে দুই থেকে আড়াই টাকা শ্রমিক খরচ হলেও এখন তা ৮-১০ টাকা।
সে অনুপাতে পণ্যের দাম বাড়েনি। মহামারির আগে হাঁড়ি-পাতিল প্রতি কেজি আগে পাইকারিতে ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তা ৩৭০ টাকা। কলস ৩৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫০-৪৭০ টাকা করা হয়েছে। গামলা ২৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. একরামুল হক বলেন, "মহামারিতে লোকসানের পর যুদ্ধের কারণে কাঁচামালের সংকট ও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর জ্বালানী সংকটের কারণে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস লোকসান দিতে হয়েছে। এসময়ে উৎপাদন ৩০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল।"
টিকে থাকার সংগ্রামে কৌশলী বড় কারখানাগুলো
অ্যালুমিনিয়ামের পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি তিন ধাপের। প্রথমে কাঁচামাল থেকে গ্যাসের চুল্লিতে গলিয়ে ইংগোট বার তৈরি হয়। এরপর ইংগোট বারের সঙ্গে পুরাতন অ্যালুমিনিয়াম পণ্য রোলিং মিলে গলিয়ে সার্কেল হয়। শেষ ধাপে সার্কেল থেকে স্পিনার মেশিনে হয় ব্যবহারের পণ্য। উৎপাদনের তিনটি ধাপে স্বল্প পুঁজি দিয়ে পৃথক কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। বাজার প্রতিযোগিতায় মুনাফা কমেছে। টিকে থাকতে বড় কারখানাগুলো নিজেরাই উৎপাদনের সব ধাপ সম্পন্ন করছে।
১৯৯০ সালের পর মোহাম্মদপুরের মেসার্স সাকিব মল্ডিং এবং শহীদ অ্যালুমিনিয়াম ইন্ড্রাস্টিজ শুধুমাত্র ইংগোট বার তৈরি করতো। মুনাফার হার কমতে থাকায় প্রতিষ্ঠান দুটি ক্রমান্বয়ে রোলিং মিলে সার্কেল এবং স্পিনার মেশিনে সরাসরি অ্যালুমিনিয়াম পণ্য উৎপাদনে নেমেছে। সাব্বির অ্যান্ড ব্রাদার্স ও আল্লাহর দান অ্যালুমিনিয়াম স্পিনার মেশিনের পাশাপাশি রোলিং মিল দিয়ে সার্কেলও তৈরি করছে।
মেসার্স সাকিব মল্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. সাহিদুল ইসলাম সাকিব টিবিএসকে বলেন, "উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও প্রতিযোগিতার কারণে সে অনুপাতে পণ্যের দাম বাড়েনি। পৃথক ধাপে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালনার ফলে মজুরি বেশি ব্যয় হচ্ছে। টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে ইংগোট, সার্কেল ও পণ্য- সব নিজেরা উৎপাদন করছি।"