করোনাকালে রপ্তানিতে অগ্রগতি, নতুন ফ্যাক্টরিতে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ চীনা মেডিকেল কোম্পানির
বাংলাদেশে করোনা মহামারির লকডাউন শুরুর মাত্র ছয় মাস আগে, ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরু করেছিল চীনা প্রতিষ্ঠান জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেড।
মহামারির সময় হঠাৎ বিশ্বব্যাপী মেডিকেল পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) উৎপাদনের পরিসর বাড়াতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। সেইসঙ্গে রপ্তানিও বাড়তে থাকে।
মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠিত বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে বিশাল কারখানা করছে চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
২১০০০ স্কয়ার ফিটের এই কারখানায় অন্তত দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজার) নিবন্ধন নিয়েছিল চীনের সার্জিক্যাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কুনশান জিহং ননওভেন প্রোডাক্ট কো. লিমিটেড। ২০০৩ সালে দেশটির জিয়াংশু প্রদেশের কুনশান সিটিতে এই কারখানা স্থাপন করেন দং ওয়েইঞ্জি নামে এক চীনা নাগরিক।
বেপজায় নিবন্ধনের আড়াই বছর পর, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৮ একরের একটি প্লটে স্থাপিত কারখানাটি অপারেশনে যায়।
চীনে সার্জিক্যাল মাস্ক, গাউনসহ বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল পণ্য উৎপাদন করলেও বাংলাদেশের কারখানায় মেডিকেল গাউন উৎপাদনে জোর দেয় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে দেশের কারখানায় গাউনের মধ্যে আইসোলেশন গাউন, পেশেন্ট গাউন, স্কার্প গাউন, স্ক্রার্ব স্যুট ও ল্যাব জ্যাকেট তৈরি হয় এ কারখানায়। এছাড়া ক্যাপ, সু-কভার, কভার অলও উৎপাদন করে। মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ গাউন। বাকি ২০ শতাংশ ক্যাপ, শু-কভারসহ অন্যান্য পণ্য।
জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) তানভীর মোহাম্মদ সাজ্জাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের কারখানায় উৎপাদন শুরুর কয়েক মাসের মাথায় মহামারি শুরু হয়। তখন আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। রপ্তানির পরিসরও বাড়াতে থাকি।"
তিনি জানান, শুরুতে মাত্র ১০০ জনবল নিয়ে মাসে ১-২ লাখ পিস পণ্য উৎপাদন হতো। বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন কর্মরত রয়েছেন। মাসিক উৎপাদন ৩-৪ লাখ পিসে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজার) তথ্যমতে, চালুর পর প্রথম চার মাসে অর্থাৎ ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৪৫ মার্কিন ডলার।
শুরুতে শুধু নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সে পণ্য রপ্তানি করতো। এরপর বিশ্বজুড়ে মহামারির প্রকোপ বাড়ায় এই পণ্যের সংকট দেখা দেয়। তখন রপ্তানি তালিকায় যুক্ত হতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, স্পেন, কানাডার মতো করোনা সংক্রমণের আঘাতে বিপর্যস্ত দেশগুলো।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে রপ্তানি আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩ লাখ ১০ হাজার ২২১ মার্কিন ডলারে পৌঁছে। এরপর শুধু রপ্তানি আয় বেড়েছে।
এই বছরের এপ্রিল থেকে জুনে ১ কোটি ৫২ লাখ ৬১ হাজার ৬৯১ মার্কিন ডলার, জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৫৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫ হাজার ১৩৪ ডলার এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে ৪৯ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৬ মার্কিন ডলার ছোঁয় রপ্তানি আয়।
২০২১ সালের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জানুয়ারি-জুনে ১০৭৫ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০৭ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ১২ ডলার) এবং শেষ ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে ১২৩৬ দশমিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১২৩ কোটি ৬৬ লাখ ৬ হাজার ৩২৯ ডলার) রপ্তানি আয় হয়।
২০২২ সালের জানুয়ারি-জুনে ১৩৫২ দশমিক ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৩৫ কোটি ২৮ লাখ ১১ হাজার ৯১৩ ডলার) রপ্তানি আয় হয়।
প্রতিষ্ঠানটির চীন ও বাংলাদেশের দুটি কারখানায়ই নন ওভেন পণ্য তৈরি হয়। এসব পণ্য একবার ব্যবহারের জন্য।
এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় নন ওভেন ফেব্রিক ও ইলাস্টিক। এরমধ্যে ফেব্রিক আনা হয় চীন থেকে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের নতুন কারখানায় নন ওভেন ফেব্রিক উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক ট্রিশ ওয়াং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মহামারির সময় কারখানার পরিসর বাড়াতে চট্টগ্রাম ইপিজেডের ভেতরেই রেডিমেড ভবন খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাইনি। ২০২০ সালের শেষদিকে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের জন্য নিবন্ধন নিয়েছি।"
"সেখানে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে প্রায় ২১ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গাজুড়ে কারখানার নির্মাণ কাজ চলছে। ২০২৩ সালের শেষদিকে নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।"
ওই কারখানায় ব্যবহার উপযোগী পণ্যের পাশাপাশি কাঁচামাল নন ওভেন ফেব্রিকও উৎপাদন করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। "বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করে মাসে ৭-৮ লাখ পিসে পৌঁছাবে এর উৎপাদন," বলেন তিনি।
তিনি আরো জানান, "সস্তা শ্রম মূল্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতারসহ উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশের কারণে আমরা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর বন্দরনগরীর সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে জায়গা হিসেবে চট্টগ্রাম নির্ধারণ করেছি।"