মজুরির দাবিতে চা শ্রমিকদের ভূখা লংমার্চ
১২ সপ্তাহ ধরে মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার প্রতিবাদে রোববার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের কালিটি চা-বাগান থেকে কুলাউড়া অভিমুখে 'ভূখা লংমার্চ' করেন চা শ্রমিকরা। এই লংমার্চে তারা বেতন পরিশোধের জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন।
এতে সংহতি প্রকাশ করেন গাজীপুর ও রাঙ্গিছড়া চা বাগানের শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দ।
লংমার্চে শ্রমিকরা হাতে প্ল্যাকার্ড ও খালি থালা-বাসন নিয়ে কালিটি চা বাগান থেকে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা পায়ে হেঁটে কুলাউড়া পৌঁছেন।
শ্রমিকরা জানান, কালিটি বাগানটি জোবেদা টি কোম্পানি লিমিটেডের নামে সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে। বাগানে মোট ১ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ৫৩৭ জন। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা করে মজুরি পান। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ১২ সপ্তাহ ধরে তারা মজুরি পাচ্ছেন না। বাগানের শ্রমিক সরদার ও স্টাফদেরও ১১ মাসের বেতন আটকা পড়ে আছে।
বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সম্পাদক উত্তম কালোয়ার বলেন, শ্রমিকেরা এমনিতেই সামান্য মজুরি পান। এরপর ১২ সপ্তাহ থেকে কেউ সেই মজুরি পাচ্ছেন না। কাজ করেও মজুরি মিলছে না। ঘরে চাল-ডাল নেই। উপোস দিন কাটাতে হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষ 'আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি' বলে সময়ক্ষেপণ করছে।
চা শ্রমিক সন্তান মোহন রবিদাশ বলেন, চা শ্রমিক এবং শ্রমিক সর্দার ও স্টাফরা বেতন না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এখানে খাবার পানির একমাত্র উৎস কুয়া (কূপ)। কিন্তু খরার কারণে কুয়াগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এই বাগানে চিকিৎসার একমাত্র আশ্রয়স্থল যে হাসপাতাল, সেখানেও ৩ মাস ধরে চিকিৎসাসেবা বন্ধ।
তিনি অভিযোগ করেন, এই বাগানের চা শ্রমিকদের ২৬ মাসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বাগান মালিক। বাগানটিতে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরের কথা, সামান্য একটা মাস্কও কেউ দেয়নি। তাই ৯৯ ভাগ শ্রমিক মাস্ক ছাড়াই চা বাগানে কাজ করছেন।
তিনি আরও জানান, কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে যে কয়েকজন যুবক এই বাগানে প্রবেশ করেছে, তাদের ব্যাপারেও প্রশাসন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
রবিদাশ বলেন, মানুষ পেটের দায়ে আজ আন্দোলন করছে, ভূখা মিছিল করছে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না। তারপরও তাদের প্রতি কেউই দৃষ্টিপাত করছে না। শ্রমিকদের বেশিরভাগ ঘরই ছনের। দীর্ঘ ২ বছর ধরে ঘর-বাড়ি মেরামত না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙা ঘরে বাস করছেন এই বাগানের মানুষগুলো।
দয়াল অলমিক বলেন, বাগানে চিকিৎসক নেই। শ্রমিকেরা বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করালে বাগান কর্তৃপক্ষ বিলের টাকা দেয় না। বাগানে বিরাজমান এসব সমস্যার কথা তুলে ধরে এর প্রতিকার চেয়ে ৫ জানুয়ারি তারা শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
চা শ্রমিক নেতা বিশ্বজিত দাস বলেন বলেন, একদিকে ১২ সপ্তাহ ধরে মজুরি বঞ্চিত, অন্যদিকে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে আছেন এই বাগানের শ্রমিকরা। অবিলম্বে সংকট নিরসন করা না গেলে শত শত চা শ্রমিকের জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান না হলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সম্ভু চৌধুরী দাশ বলেন, বাগানে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যা। শ্রমিকদের আগের মজুরিরও বেশ কিছু টাকা বকেয়া পড়ে আছে। অনেক শ্রমিক জরাজীর্ণ কাচাঘরে বাস করছেন। এসব ঘর মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অবসরে যাওয়া শ্রমিকেরা তহবিলের টাকা পাচ্ছেন না। অথচ প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি থেকে সাত শতাংশ করে ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা কেটে রাখা হয়। এর সঙ্গে মালিক পক্ষ আরও সাত শতাংশ যোগ করে মোট ১৫ শতাংশ টাকা শ্রম অধিদপ্তরে জমা দেওয়া কথা। বাগান কর্তৃপক্ষ তা-ও করছে না।
মজুরি বন্ধের বিষয়ে কালিটি বাগানের ব্যবস্থাপক প্রণব কান্তি দাশ বলেন, কোম্পানির কাছ থেকে যথাসময়ে টাকা না পাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তার নিজেরসহ বাগানের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১১ মাসের বেতন বন্ধ আছে বলেও জানান তিনি।
কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফি আহমেদ সলমান বলেন, মালিকের সঙ্গে কথা বলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করব। অন্যথায় মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।