রুশ জাহাজে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা: কেমন প্রভাব পড়বে দুই দেশের সম্পর্কে
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ৬৯টি রুশ জাহাজের বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এবং এক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে যে এই সিদ্ধান্ত "বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এবং এতে করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।"
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু সংস্থা রোসাটম; ২০২৪ সাল থেকে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। ঢাকা মস্কোকে অনুরোধ জানিয়েছে যেন এই প্রকল্পের জন্য মালামাল বহনকারী জাহাজগুলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় না থাকে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, রাশিয়া 'ইচ্ছাকৃতভাবে' নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা একটি জাহাজের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পাঠিয়েছে।
সাম্প্রতিক এই ঘটনাবলি রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা জানতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
'রুশ সরকার বুঝতে পারছে বাংলাদেশ কী রকম বেকায়দা অবস্থায় রয়েছে'
হুমায়ুন কবির
সাবেক রাষ্ট্রদূত
নিষিদ্ধ জাহাজগুলো আটকে দেওয়ার ঘটনায় রাশিয়া যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাশিয়ার যে মাত্রার সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাতে করে আমাদের আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিল। সহজেই বোধগম্য যে এ ঘটনায় তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। এছাড়াও তারা এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার ছিল।
সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের রুশ দূতাবাসের কাছে যথাযথভাবে গোটা ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে হবে। নতুন করে কোনো ভুল পদক্ষেপ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলা চলবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কূটনৈতিক কার্যক্রম ও দক্ষতার মানও উন্নত করতে হবে।
যদি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা জানতে চাওয়া হয়, সে ব্যাপারে আসলে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল যে এই ঘটনায় বাংলাদেশ-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না। তবে এতে করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
আমি যতটুকু অনুধাবন করতে পারি, রুশ সরকারও বুঝতে পারছে যে বাংলাদেশ কী রকম বেকায়দা অবস্থায় রয়েছে, কেননা আমাদেরকে তো পশ্চিমের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কূটনীতিকরা এ ধরনের সূক্ষ্ম ব্যাপারকে কৌশলের সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে পারবে, আমাদের কোনো সমূহ বিপদের আশঙ্কা নেই।
'রাশিয়ারও বাংলাদেশকে প্রয়োজন'
ড. মোঃ আব্দুল মান্নান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি অবস্থান নেওয়ার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গে 'প্রক্সি ওয়ার'-এ আছে, এবং তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলার। বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ রুশ জাহাজগুলোকে আটকে দেওয়াও নিছকই তাদের সেই রণকৌশলের একটি অংশ।
বাংলাদেশ হয়তো সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক অস্থিরতারও একটি রঙ্গমঞ্চে পরিণত হবে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্র জোর চেষ্টা চালিয়েছে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)-এ যুক্ত করার।
তবে মনে হয় না জাহাজ আটকে দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড় ধরনের আঁচড় ফেলবে। রাশিয়ারও তো বাংলাদেশকে প্রয়োজন। পশ্চিমারা রাশিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, তাই তাদের এখন মিত্র দেশের খুব প্রয়োজন, যাতে করে জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তারা নিজেদের পক্ষে ভোট টানতে পারে।
আর যদিওবা এই ঘটনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রভাবিত হয়, তবু আমাদের খুব বেশি কিছু করার নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই আরএমজি আমদানিকারক, এবং ভারত ও চীনের বাইরে বাংলাদেশের বৃহত্তম দুই বাণিজ্যিক অংশীদার। তাই এটা স্বাভাবিক যে রাশিয়ার চেয়ে তাদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ।
'পরিস্থিতি শীঘ্রই স্বাভাবিক হয়ে যাবে'
মোঃ শহিদুল হক
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
রাশিয়ার দিক থেকে চিন্তা করলে এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। একটা দেশ যদি আরেকটি দেশের এত বিপুল সংখ্যক জাহাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে সেটি নিয়ে দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা তো হবেই। ঠিক তেমনই, রাশিয়ারও এক্ষেত্রে নিজস্ব একটি অবস্থান রয়েছে, এবং সেটি সম্পর্কে বাংলাদেশকে অবগত করার জন্যই তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে।
তবে আমার মনে হয় না এটি এত বড় কোনো ইস্যু যার ফলে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চিড় ধরবে। কেননা আমার মতে এটি নিছকই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমন তুচ্ছ কোনো ঘটনায় দুটি দেশের এতদিনকার সম্পর্ক প্রভাবিত হয় না।
তাছাড়া একটি দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করাও তো আজকাল খুবই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমরাও নিয়মিত এই কাজ করে থাকি, এবং সাম্প্রতিক সময়ে আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছি। এটির [রাষ্ট্রদূতকে তলব] মাধ্যমে মূলত দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়, নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়, এবং সমস্যার সমাধান বের করে আনা হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে বরাবরই রাশিয়ার খুবই শক্ত সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া ও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। আমার বিশ্বাস, সাম্প্রতিক ঘটনার জের ধরে সেগুলোতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। পরিস্থিতি খুব দ্রুতই শান্ত হয়ে যাবে এবং এর ফলে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাবেরও সম্ভাবনা নেই।
'বাংলাদেশ ঠিক তা-ই করেছে যা তাদের করা উচিত ছিল'
মোহাম্মদ রুহুল আমিন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রদূতকে তলব করা নিশ্চিতভাবেই একটি নেতিবাচক বার্তা দেয় যে সামনের দিনগুলো কঠিন হবে [দুই পক্ষের জন্যই]। কিন্তু একই সঙ্গে, আমার মনে হয় না এখানে বাংলাদেশের কোনো ভুল ছিল।
যে জাহাজগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর উপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখানে বাংলাদেশ আর কী-ই বা করতে পারত? যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক পরাশক্তি, এবং তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সামিল। বাংলাদেশ একটি তুলনামূলক ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্র হয়ে সেরকম কিছু করতে পারে না।
আমার এটিও মনে হয় না যে রুশ জাহাজ নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ রাশিয়াকে অপমান করেছে, কিংবা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের যা করা উচিত ছিল, ঠিক সেটিই তারা করেছে।
রাশিয়া নিশ্চিতভাবেই এই ঘটনার সুবাদে বাংলাদেশের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছে, তবে আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এটি এতদূর অবধি গড়াবে যে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়াও অচিরেই বুঝতে সক্ষম হবে যে বাংলাদেশের সামনে আসলে অন্য কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। তাই তারা আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে।
তাছাড়া, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিরও আমি প্রশংসা করব। কোনো একটি পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা আমাদের জন্য সেরা সিদ্ধান্ত ছিল।