ক্রেতাশূন্য বঙ্গবাজার, বিবর্ণ ঈদের শঙ্কায় হাজারো ব্যবসায়ী
খোলা আকাশের নিচে চৌকিতে বঙ্গবাজার পোড়া মার্কেট পুনরায় চালু হলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে। ঈদের আগে এই সময়টা যে মার্কেটে ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক, সেই মার্কেট এখন নিষ্প্রাণ, বলা যায় ক্রেতাশূন্যই।
যেসব দোকানিরা প্রতিবছর তুলনামূলক কম দামে পোশাক বিক্রি করে ঈদে-চাঁদে মানুষের মুখে হাসি ফুটাতেন, সেইসব ব্যবসায়ী-কর্মচারীরাই এবার পরিবারের ঈদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় হতাশ; কারোই চোখেমুখে আসন্ন ঈদের আনন্দের ছাপ নেই।
রবিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দোকানি- সেলসম্যান ও ম্যানেজাররা গল্প করে, কেউবা মোবাইল দেখে সময় পার করছেন, দুয়েকজন ক্রেতা আসলে সকলেই ডাকছে সেই ক্রেতাকে- যেন তার দোকান থেকে কিনে। কেউ কেউ বিক্রি কম ও প্রচণ্ড গরমের কারণে সকাল থেকে দোকানই খোলে নি।
কথা হয় এফএনএফ গার্মেন্টস-এর মালিক শহিদুল ইসলামের সাথে। আগুনে তার ৪টি দোকান একদম ছাই হয়ে যায়; ২০ লাখ টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছর এই সময় এক দিনে ২-৩ লাখ টাকা বিক্রি হতো, দুপুর ১২টার আগে এক থেকে দেড় লাখ টাকার পাইকারিই সেল করতাম, অথচ আজকে সকাল থেকে মাত্র ২০০ টাকা বিক্রি করছি, গতকাল সারাদিনে ৬০০ টাকা বিক্রি করেছি।"
দোকানটির সেলসম্যান মোহাম্মদ হিমেল বলেন, "এই সময় আমরা আশেপাশে তাকানোর সময় পেতাম না কাস্টমারের চাপে, ঠিকমতো ইফতার করতে পারতাম না কাস্টমারের ভিড়ে, আর আজকের সারাদিন বসেই দিন কাটাচ্ছি, কোন কাস্টমারই নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আমার বেতন ছিল ১৬ হাজার টাকা, বোনাস-মহাজনের বকশিস সবমিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঈদে বাড়ি নিতে পারতাম, কিন্তু এবার তো দোকান মালিকের সন্ধ্যায় আমাদের ইফতারি কিনে দিতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
অপর দোকান মালিক শাহাদাত হোসেন বলেন, "আমরা ১৫ রোজার আগে বেশিরভাগ মাল পাইকারি বিক্রি করে ফেলতাম, আমাদের কোন খুচরা কাস্টমার ছিলো না, ২৭ রোজার পরে গিয়ে মন চাইলে খুচরা মাল বিক্রি করতাম, কিন্তু এবার আগুনে পোড়ার কারণে আগের পাইকারি ক্রেতারা আর আসেনি।"
তিনি বলেন, "ভাবছিলাম চৌকিতে দোকান চালু করেছি শুনে পুরাতন কাস্টমারগুলো হয়তো আসবে,কিন্তু এবার তেমন কিছু হচ্ছে না, সারাদিনে একপিস প্যান্ট বিক্রি করেছি।"
শাহাদাত হোসেনের ৯ লাখ টাকা ব্যাংক লোন রয়েছে, পাশেই শাহাদাত হোসেনের ভাইয়ের আরেকটি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে- সবমিলিয়ে শাহাদাত হোসেন ঘুরে দাঁড়ানো স্বপ্ন অনেক কঠিন হয়ে গেছে বলেন জানান।
শাহাদাত হোসেনের দোকানের বিক্রয়কর্মী শাহেদ হোসেন বলেন, "গতবছর বেতন বোনাসসহ ১ লাখ টাকা পেয়েছি, সারাবছর এই টাকার আশায় থাকতাম, কিন্তু মালিক নিজেই পথে বসে গেছে, আমাদের কিছু যে দিবে সেই অবস্থাও নাই, আর আমরাও যে কিছু আবদার করবো তেমন বিক্রি হচ্ছে না।"
দেখা যায়,দুপুর ১২টা-১টার সময় পুরো মার্কেটজুড়ে হাতে গোনা ১৫-২০ জন ক্রেতা রয়েছে, অথচ চৌকি দোকান চালু হয়েছে পাঁচশোর অধিক।
কথা হয় হাদিউজ্জামান নামে একজন ক্রেতার সাথে, তিনি মা, বাবা, ভাগিনা, ভাগ্নির জন্য কেনাকাটা করেছেন এই মার্কেট থেকে।
হাদিউজ্জামান বলেন, "মার্কেটে ক্রেতা না থাকার কারণে সবকিছু মোটামুটি অনেক সস্তায়ই কিনতে পেরেছি, তেমন একটা দরকষাকষি করতে হয়নি।"
তিনি বলেন, "আমি মায়ের জন্য দুইটি শাড়ি কিনেছি ৭৫০ করে দুইটা ১৫০০ টাকা। আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক লস দিয়ে দোকানদার শাড়িগুলো বিক্রি করে দিয়েছে, কারণ মার্কেটে তো ক্রেতাই নেই।"
অপর ক্রেতা নাজমুল হাসান বলেন, "বাচ্চাদের জন্য ৩ হাজার টাকার পোশাক কিনেছি এখান থেকে, অনেক কম দামেই পেয়েছি সবকিছু।"
গত ১১ দিন আগে (৪ এপ্রিল) আগুনে নিঃস্ব হয়ে যায় এখানকার দোকানিরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হওয়া সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর মালামালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি।
দোকানিরা ভাবছিলেন, চৌকিতে দোকান পুনরায় চালু করলে অন্তত তিনভাগের একভাগ কাস্টমার পাওয়া যাবে, কিন্তু আগের তুলনায় ৫-১০ শতাংশও বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
অধিকাংশ দোকানির মালামাল পুড়ে যাওয়ায় আর মাল না থাকায় ও পুঁজি না থাকায় চৌকিতে পর্যন্ত দোকান চালু করতে পারেনি।