ইমরানের গ্রেপ্তার সেনাবাহিনীর ইশারাতেই?
আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যানকে ইমরান খানকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর আজ তার ৮ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করা হয়েছে।
আল-কাদির ট্রাস্টের নেতৃত্বে আছেন ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি। দেশটির ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) বলছে, এই ট্রাস্টে 'দুর্নীতির' দায়ে ইমরানকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
বিবিসি জানাচ্ছে, নির্মাণাধীন আল-কাদির ইউনিভার্সিটিকে ৫৬ একরের মতো জমি দান করেছিল ইসলামাবাদের আবাসন কোম্পানি বাহরিয়া টাউন। কিন্তু দেশটির পিডিএম সরকারের (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) অভিযোগ, কোম্পানিটি অনুদান হিসেবে দেয়নি—দিয়েছে বাহরিয়া টাউনের প্রতিষ্ঠাতা মালিক রিয়াজ ও ইমরান খানের সরকারের মধ্যে একটি গোপন চুক্তির সুবাদে। এ লেনদেনে 'দেওয়া-নেওয়ার' সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ তাদের।
এ মামলায় অবশেষে গতকাল গ্রেপ্তার হন ইমরান। তার গ্রেপ্তারের পরই সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান। বিক্ষোভকারীরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। এমনকি সেনানিবাসেও হামলা চালিয়েছে তারা।
বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর হচ্ছে। বিবিস ও দ্য ডন-এর খবর, প্রায় আটজন নিহত ও কয়েকশ গ্রেপ্তার হয়েছে।
এদিকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর উদ্ভূত সহিংসতায় বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর)। তারা বলেছে, ৯ মে পাকিস্তানের ইতিহাসে 'কালো অধ্যায়' হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর 'সেনাবাহিনীর সম্পত্তি ও স্থাপনা টার্গেট করে' বিক্ষোভ বা ভাংচুরের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলে আইএসপিআর।
বিবৃতিতে আইএসপিআর আরও বলে, 'আমরা কাউকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেব না।' চলমান বিক্ষোভে সেনাবিরোধী স্লোগান দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
আইএসপিআর বলেছে, দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতির আবেগকে কাজে লাগাচ্ছে; আবার অন্যদিকে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। 'এটি দ্বিচারিতার নজির।'
আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী চরম সহিষ্ণুতার পরীক্ষা দিয়েছে। তবে কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে এবং মানুষকে উসকে দিতে দেওয়া হবে না বলে দাবি করা হয় বিবৃতিতে।
পিটিআই প্রধানকে গ্রেপ্তারের একদিন পর এ বিবৃতি দিল আইএসপিআর।
মঙ্গলবার ইমরানকে গ্রেপ্তার করার একদিন আগেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল আইএসপিআর। সেখানে ইমরানকে আহ্বান জানানো হয়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে 'ভিত্তিহীন' অভিযোগ আনা বন্ধ করতে।
বছরখানেক ধরেই ইমরানকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। অবশেষে এনএবির ইস্যু করা সমনে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জার্সের সহায়তায় তাকে গ্রেপ্তার করেছে এনএবি।
দ্য ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমরানের গ্রেপ্তারে পাঞ্জাব পুলিশ যুক্ত থাকলেও আদালত চত্বরে এ কাজ করার সাহস তাদের ছিল না। তাই এ দায়িত্ব দেওয়া হয় রেঞ্জার্সকে।
এ ঘটনায় দুটি প্রশ্ন উঠেছে—১. পুলিশের ক্ষমতা রেঞ্জার্স পেল কী করে? ২. এনএবি ও রেঞ্জার্সের মধ্যে কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক আছে?
পাকিস্তান রেঞ্জার্স অর্ডিন্যান্স-এর (১৯৫৯) ক্ষমতা বলে রাষ্ট্র সীমান্ত এলাকা রক্ষায় আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে পারে। তারা প্রয়োজনের সময় পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করে। এছাড়া সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদ ও অ্যান্টি-টেররিস্ট অ্যাক্ট (১৯৯৭)-এর আওতায় রেঞ্জার্সদের পুলিশের কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
রেঞ্জার্সকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মোতায়েন করা হলেও আধাসামরিক বাহিনীটি আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট কিন্তু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে।
আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পাকিস্তান রেঞ্জার্সের সিনিয়র ক্যাডাররা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। তারা সাধারণত কর্মরত সেনা কর্মকর্তা হয়ে থাকেন। পদায়নের পর অনেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি পান।
এনএবি অর্ডিন্যান্স-এর (১৯৯৯) সুবাদে এনএবি পুলিশ অথবা 'অন্য যেকোনো সংস্থার' সহায়তা চাইতে পারে। তার বদৌলতেই তারা রেঞ্জার্সের সহায়তা নিয়েছে।
রেঞ্জার্স অতীতেও এরকম অনেক গ্রেপ্তারের কাজ করেছে।
সব বিবেচনায় চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাত ধুয়ে ফেলতে চাইলেও ঘটনার পূর্বাপর ইঙ্গিত করছে এসবের পেছনে সেনাবাহিনীর মদদ থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ—এমনটা বলছে দ্য ডন-এর মতো সংবাদমাধ্যম।
ডন বলছে, ইমরানকে গ্রেপ্তারের আরও বিতর্কিত হলো বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক কারসাজিতে সেনাবাহিনীর অতীত ভূমিকা বাহিনীটির বর্তমান নেতৃত্ব যতই ভুলতে চান না কেন, বিগত মাস ও বছরগুলোতে যে ধারণা সবার মনে বদ্ধমূল হয়েছে, তা রাতারাতি উবে যাবার নয়।