মৃণাল সেনের ছেলে কেন বাবাকে ‘বন্ধু’ ডাকতেন
বাবাকে যে কখন বন্ধু নামে ডাকতে শুরু করেছি সে কথা আজ আর কারোই মনে নেই। সত্যি বাবাকে বন্ধু নামে ডাকাটা অদ্ভুত । আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় বন্ধু বলতে ইয়ার বা দোস্তকেই বোঝানো হয়। বন্ধু ডাকার একটা কারণ হতে পারে যে আমার সাথে খেলতে খেলতে হয়তো তিনি একবার বলেছিলেন আমরা দু'জনে বন্ধু। সে শব্দটি আমার মনকে দখল করে নেয়। কার্যকারণ যাই হোক না কেন বাবাকে আমি কেবল বন্ধু নামেই ডাকতাম।
ছোটবেলায় এতে তেমন সমস্যা দেয়নি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবাকে ওই নামে ডাকা নিয়ে আত্ম-সচেতন হতে থাকি। কিন্তু তারপরও কেন বাবার মতো সর্বজনগ্রাহ্য নামে তাকে ডাকা শুরু করিনি সে কারণ আমার জানা নেই। আট বা নয় বছর বয়সে সাউথ পয়েন্ট নামের একটি স্কুলে লেখাপড়া করেছি। সে সময় স্কুল বাসে করেই যাতায়াত করতাম।
একদিন কোনো কারণে বাবা আমাকে আনতে গেলেন। ছুটির আগে যাওয়ার জন্য অনুমতির দরকার। অনুমতি নিতে স্কুলের দফতরে গেলাম। কেউ আমাকে নিতে এসেছে কি না জানতে চাওয়া হলো। বললাম, 'জি।' 'কে নিতে এসেছেন?' তারপরই জানতে চাইল। মুশকিলে পড়লাম। আমি বন্ধু বলতে পারছি না। অন্যদিকে বাবা ডাকাটা আরও কষ্টকর হচ্ছে। সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত বললাম, 'একজন লোক।' ভাগ্য সুপ্রসন্ন। এতেই কাজ হলো। দফতর থেকে আমাকে আগে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো।
আমার সৌভাগ্য বলতে হবে, ছেলেবয়সে আমার বন্ধু-বান্ধবদের সামনে তাঁকে ডাকতে হতো না। আর অন্যদের সাথে আলাপচারীর সময় তাঁকে 'বাবা' হিসেবে উল্লেখ করতাম। কাজেই আমার গোপন কথাটি ভালোভাবে গোপনই রয়ে গেল।
কিন্তু আমার বয়স যখন ১০ তখন একটি ঘটনা ঘটল। ঘটনাটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। সরস্বতী পূজার সময় হাজার হাজার মাটির মূর্তিকে বিসর্জনের জন্য সন্ধ্যায় নদীপারে নিয়ে যাওয়া হয়। বিসর্জন দেখার জন্য আমাকেসহ আমাদের বন্ধুদেরকে নদীপারে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। সে সময় তার একটি ছায়াছবির চিত্রগ্রহণের পর্ব চলছিল। প্রোডাকশন দলের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। তাতে আমাদের সবাই এঁটে যাব। এর আগে আমরা কেউ বিসর্জনের দৃশ্য দেখিনি। তাই বেশ পুলকিত হলাম। দলেবলে সবাই গাড়ির ভেতরে কিনার ঘেঁষে বেঞ্চে বসে পড়লাম। যাত্রা শুরু হলো।
আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হলো। আমাদের প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেল সে দিনের ঘটনাবলো। শত শত সরস্বতী মূর্তিকে পানিতে ফেলা হতে থাকল। ওগুলোতে ভেসে যেতে দেয়া হলো। বিসর্জন শেষে মেট্রো সিনেমার পাশে একটি চিপা গলিতে আমাদের নিয়ে গেলেন বাবা। এক জায়গায় কুলফি বিক্রি হচ্ছিল। বাবা আমাদের সবাইকে কুলফি কিনে দিলেন। একজন আইসক্রিমগুলো আমাদের জন্য নিয়ে এলেন। দাম মেটাতে বাবা গাড়ি থেকে নামলেন। তিনি না ফেরা পর্যন্ত গাড়ি থেকে কেউকে নামতে মানা করে গেলেন।
এর মধ্যে আমাদের এক বন্ধুর পিপাসা লাগল। তার জন্য পানি দরকার। স্বাভাবিক ভাবেই দায়িত্বটা আমার ওপরই বর্তাল। এবারে আমি পড়লাম মুসিবতে। বাবা বেশ দূরে। কুলফির দোকানের সামনে। গাড়ি থেকে নামতে মানা করে গেছেন। আমার কচি মাথায় চিন্তার ঢেউ খেলতে লাগল। সম্বোধনের গোপন কথাটি গোপন রেখে কী করে বাবার নজর টানা যায় সে চিন্তা করতে লাগলাম। শেষে 'মৃণালদা' বলে হাঁক ছাড়লাম। এভাবে বড় ভাইদের ডাকা হয়, বাবাকে নয়। এ ডাক আমাদের বন্ধুদের কাছে কতটা অদ্ভুত শোনাতে পারে সে কথা একবারও মাথায় আসেনি।
তবে বয়স বাড়ার সাথে আমার ভয় বা লজ্জা কেটে গেল। আলাদাভাবে বাবাকে লোকসম্মুখে বন্ধু নামে ডাকতে ইতস্তত করতাম না। হাই-স্কুলে পড়ার সময় প্রথম সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' দেখি। চলচ্চিত্রটির শেষের দিকে অপুর (সৌমিত্র চ্যার্টাজি) সাথে শেষ পর্যন্ত তার ছোট্ট ছেলে কাজলের সাক্ষাৎ হয়। ছেলেটি প্রশ্ন করে, 'তুমি কে?' দাঁড়িগোফওয়ালা অপু জবাব দেয়, 'তোমার বন্ধু।' কথাটি খুবই সুন্দরভাবে আমার বেলায় লাগসই হয়েছে।
কলেজে আমার বন্ধুমহলের বিস্তার ঘটল। আমার বন্ধু-বান্ধবরা দিনের অনেকটা সময়ই আমাদের বাসায় কাটাত। বাবা তাদেরকে 'মৃণালদা' ডাকতে উৎসাহিত করতেন। কাকা বা জেঠু ডাকাটা মোটেও পছন্দ করতেন না। এভাবেই আমার সব বন্ধু-বান্ধব এবং জগতজুড়ে তার পরিচিত মহল তাকে 'মৃণালদা' ডাকতে শুরু করেন। নিশা (পরে তাকে বিয়ে করি) এবং বোন জাগৃতিসহ আমাদের কয়েকজন বান্ধবীও তাকে 'বন্ধু' নামেই ডাকত। আমরা স্কুলজীবনের বন্ধু, তাই তাকে কোনো বিশেষ নামে ডাকা নিশার জন্য কোনও দরকার ছিল না। তবে আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরুর পর নিশা তাকে 'বন্ধু' বলেই ডাকত।
- অনুবাদ: সৈয়দ মূসা রেজা