হিন্দি সিনেমার শর্তসাপেক্ষ মুক্তি দর্শক আর শিল্প দুইয়ের জন্যই ভালো
গত ১২ মে শুক্রবার বাংলাদেশে মুক্তি পেল শাহরুখ খান অভিনীত ব্লকবাস্টার সিনেমা পাঠান। সিনেমাটি কেবল ভারতে নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই বিপুল সাড়া ফেলেছে। এখন পর্যন্ত হাজার কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করেছে সিনেমাটি; সূচনা করেছে ওয়াইআরএফ স্পাই ইউনিভার্স-এর। বাংলাদেশে প্রথম দিনেই সিনেমাটি বেশ ভালো আয় করেছে। শাহরুখ খান ভক্তদের বাঁধভাঙা উল্লাস দেখা গেছে অনেক সিনেমা হলে। তবে পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে — হিন্দি সিনেমার মুক্তি কি বাংলাদেশি সিনেমার জন্য ভালো হবে?
বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনো ব্যাপক আকারে ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দি সিনেমা মুক্তি পায়নি। মাঝে কেবল বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তিনটি হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল — আমির খানের থ্রি ইডিয়টস, শাহরুখ খানের মাই নেম ইজ খান এবং সালমান খানের ওয়ান্টেড। এসব সিনেমার মুক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এবারও পাঠান-এর বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয়েছে — সাফটা চুক্তির আওতায় আগামী দুই বছরে ১৮টি হিন্দি সিনেমা মুক্তি পাবে দেশে। পাঠান-এর বিপরীতে ভারতে পাঠানো হয়েছে ২০১৮ সালে নির্মিত শাকিব খানের পাংকু জামাই সিনেমাটি।
হিন্দি সিনেমামুক্তি নিয়ে এবারের বিতর্কে কিছু বক্তব্য বেশ যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। আবার অনেকেই নিতান্ত হাস্যকর বক্তব্য দিয়েছেন। তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা মুক্তি পাওয়া দেশের সিনেমাশিল্পের জন্য বিরাট কোনো বিপর্যয় বয়ে আনবে না। বরং ভালো কিছুই আমরা আশা করতে পারি এর থেকে। মুক্তবাজার অর্থনীতি সূত্র বলে, প্রতিযোগিতা যেকোনো ইন্ডাস্ট্রিকে বিকশিত করে — কারণ তখন আর নিজের গণ্ডির ভেতরে আটকে থাকার সুযোগ থাকে না।
যারা হিন্দি সিনেমার বিপক্ষে, তাদের একটি শক্ত যুক্তি হলো হিন্দি সিনেমা মুক্তি দিলে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে, শিল্পীরা নিদারুণ পরিস্থিতিতে পড়বেন। ভারতের শতকোটির বাজেটের সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না আমাদের সিনেমা। তারা আরও বলছেন, দেশীয় সিনেমা সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, এখন হিন্দি সিনেমা এলে তা হোঁচট খাবে। আবার হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আলাপের যৌক্তিকতা কতটুকু তাও চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের তথাকথিত 'কমার্শিয়াল' সিনেমার প্রধানতম সমস্যা হলো স্বকীয়তার অভাব। আমাদের অধিকাংশ নির্মাতারা সিনেমাতে আমাদের গল্প বলেন না। তারা তামিল, হিন্দি বা কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি থেকে গল্প, সংলাপ, এমনকি দৃশ্য পর্যন্ত নকল করেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কমার্শিয়াল সিনেমা এই দোষে দুষ্ট। হিন্দি বা তামিল সিনেমার নকল করার প্রবণতা নব্বইয়ের দশক থেকেই চলছে; এবং সিনেমার ট্রেড প্রোটেকশনিজম এই দোষকে কেবলই বাড়িয়েছে। ইন্টারনেট বা ক্যাবল টিভি আসার আগ পর্যন্ত এসব নকল সিনেমা চলতে পারত; এখন পারে না। দর্শক কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে নকল দেখতে যাবেন — এ প্রশ্নটি উঠে আসেনা। তার কারণ দর্শকদের সংগঠিত সমিতি নেই এবং তাদের পক্ষে বিরাট বিবৃতি দেবার কেউ নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি সিনেমা বেশ সাড়া ফেলেছে: হাওয়া, পরাণ, ও দামাল। তিনটি সিনেমার ক্ষেত্রেই একটা বিষয় সাধারণ — প্রতিটার গল্প আমাদের নিজস্ব গল্প। এই গল্পে আমাদের দর্শক নিজেদের খুঁজে পান। এই সাধারণ হিসেবটা আমাদের নির্মাতারা দর্শকদের দিতে পারছেন না। বাংলাদেশের সিনেমার কাহিনী যদি হিন্দি, তামিল বা তেলেগু সিনেমার মতো হয়, তাহলে এই বিশ্বায়নের যুগে দর্শক কেন অরিজিনাল হিন্দি, তামিল বা তেলেগু সিনেমা দেখবেন না?
বাজেট সংকট একটি বড় বিষয়, কথাটা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। সত্যিকার অর্থেই আড়াইশ কোটির পাঠান-এর সাথে দশ কোটির কোনো বাংলাদেশি সিনেমার তফাৎ হবে আকাশ-পাতাল। কিন্তু এখনাও প্রশ্ন থাকে, বাজেট কি সবসময় দরকারি? ভালো গল্প বা ভালো সিনেমার সাথে কিন্তু বাজেটের সম্পর্ক অতটা বেশি নয় — তার প্রমাণ বিশ্বের নানা দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। আমাদের পাশের দেশেই মালায়লাম বা মারাঠি ইন্ডাস্ট্রি বেশ ভালো সিনেমা নির্মাণ করছে যেগুলো হিন্দি, তামিল সিনেমার সাথেই ব্যবসা করছে। ভালো অভিনয়, ভালো ডিরেকশন, ভালো কাহিনী — বাজেটের বাইরেও এসবের ভূমিকা রয়েছে। নয়ত পাঠান-এর চেয়ে বড় বাজেটের সিনেমা সাহো আরও বেশি ব্যবসা করত।
শিল্পীরা না খেয়ে মরবেন, ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে — এই যুক্তিতে তো বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ সারা দুনিয়ার ওয়েব সিরিজ আমরা দেখতে পারি, তাও ফ্রিতে। সেখানে টাকা দিয়ে হইচই, চরকিতে সাবস্ক্রাইব করে কেন আমরা আমাদের ওয়েব সিরিজ দেখি? আমরা খালি দেখিই না, আমরা উদযাপন করি, এবং আমাদের ওটিটি কন্টেন্ট এশিয়ান কন্টেক্সটে অনেক ভালো অবস্থানে। কারণ এখানে নির্মাতারা জানেন, তাদের কম্পিটিশন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম-এর সাথে। তারা তাই নিজস্ব স্টাইল বানিয়ে নিছেন এবং এত টানাটানির মধ্যেও তারা সফল হচ্ছেন। তাহলে সিনেমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে? প্রথমত, আমাদের সিনেমার নামে নকলের যে মচ্ছব চলছে তা বন্ধ হবে; এরপর ইন্ডাস্ট্রিকে আঁকড়ে থাকা সমস্ত পরগাছা দূর হবে। তারপর হয়তো কয়টা বছর সংকটে কাটবে, কিন্তু আমরাও পারব আমাদের নিজস্ব ভাষায় সিনেমা বানাতে।
অবশ্য এখানে একটা বিপদ আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তিতে সব উন্মুক্ত করে দিলে দেশীয় সিনেমা বিপাকে পড়বে — কারণ তখন হল মালিকেরা দিন-রাত হিন্দি সিনেমাই চালাবেন। তাই হিন্দি ছবিকে 'শর্তসাপেক্ষে' চলতে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চীনের মতো কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া লাগবে। চীন বছরে ৩৪টি বিদেশি সিনেমা মুক্তি দিতে দেয়। এরকম কোটা নির্ধারণ করে দিলে দর্শকেরাও হলমুখী হবেন, দেশের সিনেমাও মার খাবেনা।
দর্শকদের হলবিমুখ হওয়ার একটি বড় কারণ — তাদের হলে যাবার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো হল পেলে, ভালো ভালো সিনেমা হলে এলে দর্শকের মাঝে সেই অভ্যাসটা আবার ফিরে আসবে। সিনেমা দিনশেষে একটা উদযাপন। এই উদযাপনটা বোঝা যায় পাঠান বা হাওয়ার মতো সিনেমার দিকে তাকালে। এই উদযাপনের চর্চাটা নব্বইয়ের দশক থেকে কমে এসেছে। এটা ফিরিয়ে আনা দরকার। এই অভ্যাসটা ফিরে এলেই দর্শক তখন তার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে শাহরুখ-সালমানদের সিনেমা দেখার পাশাপাশি দেশি সিনেমা দেখতেও হলে যাবেন।
দিনশেষে দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে দর্শককে ভালো সিনেমা দেখতে না দেওয়া বা দর্শককে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তার পকেট কাটার চিন্তা করাটা একুশ শতকের একজন শিল্পীর কাছ থেকে কাম্য নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।