একমাসের ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ৭ গুণ
দেশে এডিস মশার প্রজননকাল শুরু না হলেও এক মাস ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.২৪ গুণে। এ বছর এপ্রিল মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল আর এ মাসে মারা যান ২ জন। মে মাসে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৩৬ জনে। এ বছরের অর্ধেকেরও বেশি রোগী মে মাসে।
শুধু এক মাসে বৃদ্ধিই নয়, বিগত বছরগুলোর মে মাস পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় এবছর সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে। বিগত বছরগুলোর মধ্যে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল ৩৫২ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ২ জন। কিন্তু এবছর ৩১ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০২২ জন ডেঙ্গু রোগী এবং মারা গেছেন ১৩ জন।
এ বছর আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৮% রোগীই রাজধানী ঢাকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবছর আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ১৩৭৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং ঢাকা ব্যতীত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৪৪ জন।
এরই মধ্যে দেশের ৪১টি জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার পরে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম। এবছর ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের এবং বাকি ৩ জন চট্টগ্রামের।
জেলাগুলোর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১১টি জেলায় এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এছাড়া বরিশাল বিভাগের ৫টি, ময়মনসিংহ বিভাগের ২টি, খুলনার ৮টি, রাজশাহীর ৩টি, রংপুরের ২টি এবং সিলেট বিভাগের ১টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি বিগত বছরগুলোর চেয়ে আরও ভয়াবহ হতে পারে। সারা বছরজুড়ে যেভাবে এডিস মশা দমনে কর্মযজ্ঞ থাকা দরকার, তা নেই নগর কর্তৃপক্ষের। এমন অনেক জায়গায় এডিস লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই।
বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবন, বিভিন্ন সংস্থার মিটার বক্স, ছাদবাগানসহ বাসার মধ্যে জমে থাকা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম। কারণ, এই সময়ে বর্ষাকাল শুরু। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই এই সময়টাকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, 'এবছর ডেঙ্গুর পরিস্থিতি খুব ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী বাড়ে কিন্তু এবছর মে মাসেই যেভাবে বেড়ে গেছে তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। সামনে কোরবানীর ঈদে ঢাকা থেকে সারা দেশে ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'আমাদের নগর কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবাই বলে কাজ করছি কিন্তু ফলাফল পাচ্ছি না। তাদের কাজের মূল্যায়ন করা দরকার যে কেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেই। সাথে সাথে হটস্পট চিহ্নিত করে উড়ন্ত মশা দ্রুত মারার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জনগণকে সচেতন হতে হবে।'
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকার সমস্যা নয়, জাতীয় সমস্যা। বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও বাড়ছে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। বিভিন্ন মহামারী নির্মূলে আমাদের ইতিহাস আছে কিন্তু গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু নির্মুল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণই করতে পারিনি। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ এবং এর উপর গবেষণা দরকার।'
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় এখন ডেঙ্গু ঝুঁকিতে আছে সারা দেশের মানুষ। ১৭ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের রামুতে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, গত বছরের তুলনায় এবছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যাতে ডেঙ্গু রোগীদের সু-চিকিৎসা দিতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু রোগের হটস্পট কক্সবাজার। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলাদা নজরদারি রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যাতে বাইরে ডেঙ্গু রোগ না ছড়ায় সে ব্যাপারে সজাগ রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। একই সাথে সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগকে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার রোধ নিয়ে জরুরি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, ৩০ মে পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৪৮ জন, যা মোট সংখ্যার ১৭.৫৪%।
বুধবার দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, শুধু কীটনাশক প্রয়োগ করে নয়, ডেঙ্গু রোগ মোকাবেলায় সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
মেয়র বলেন, 'মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে দুই সিটি করপোরেশনেরই কীটনাশক কমিটি রয়েছে। কমিটিতে বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞবৃন্দ রয়েছেন। কমিটির বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা পুরো বছরের কীটনাশক আমদানি ও মজুত করেছি। এছাড়াও ২০২০ সালের পর হতে আমাদের কীটনাশকের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।'
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বুধবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা প্রচারাভিযানে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কিউলেক্স ও এডিস সব ধরনের মশার উপদ্রব কমাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের মশক কর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্কাউট ও ন্যাশনাল ক্যাডেট কোররা বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লিফলেট দিচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, কলেজে যাচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য।
মেয়র আতিক আরও বলেন, 'ডেঙ্গুর প্রকোপ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত এলার্মিং। এটির জন্য নগরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এই অভিযান চলমান থাকবে। বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে জমা পানি পেলে সেখানে আমরা অভিযান করে আইন অনুযায়ী ফাইন করবো।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ২০১৯ সালে। আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায় এবং মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য সব বছরকে ছাড়িয়ে যায় ২০২২ সাল। আক্রান্ত হয় প্রায় ৬২ হাজার এবং মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। ২০২১ সালে মোট আক্রান্ত হয় ২৮,৪২৯ জন এবং মৃত্যু হয় ১০৫ জনের।