ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু, চিকিৎসা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত
গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড না থাকা, রক্তের প্লাটিলেট দেয়ার ব্যবস্থা না থাকা, আইসিইউ ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ঢাকার বাইরের রোগীর চাপ বাড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফরিদপুরের আব্দুল আজিজ। জ্বর হওয়ার পর দুই দিন ফরিদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থা জটিল হলে চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিকেলে পাঠান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে এখন ঢাকার বাইরে থেকে আগত রোগীর চাপ বাড়ছে।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, 'ঢাকার বাইরের লক্ষীপুর, ফেনী, মাদারীপুর সহ বিভিন্ন জেলা থেকে ডেঙ্গু রোগী আসছে আমাদের হাসপাতালে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ সুবিধাও নেই। ফলে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে উপায় না পেয়ে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজন আজহার উদ্দিন জানান, গত দুইদিন আগে তার ছোটভাইয়ের তীব্র জ্বর আসে। হাসপাতালে পরীক্ষার পর ডেঙ্গু সনাক্ত হয়। পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, অবস্থা বেশি খারাপ হলে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ফাইজুর রহমান বলেন, 'আমাদের এখানে আইসিইউ সুবিধা নেই। এছাড়া রক্ত থেকে প্লাজমা তৈরির মেশিনও নেই। তবে ডেঙ্গুর জন্য যেসব পরীক্ষা-নীরিক্ষা প্রয়োজন তার প্রায় সবকটি হাসপাতালে করা যায়। রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।'
গত শনিবার (৫ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয় ৯২ জন। এর মধ্যে ৮০ জনই ডেঙ্গু রোগী। ১০০ বেডের হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ডেঙ্গু রোগীর সাথেই সাধারণ রোগীদেরও রাখা হচ্ছে। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রথম দিন থেকেই আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে তিনটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় এখন সাধারণ রোগীদের সাথেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা ডাঃ আবু তাহের জানিয়েছেন, ৫০ শয্যার কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শনিবার দুপুর পর্যন্ত শুধু ডেঙ্গুরোগীই ভর্তি হয় ৪৩ জন। একই চিত্র জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের চিকিৎসকরা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের এখানে ব্লাড সেল কাউন্টের টেস্ট ব্যতিত সব টেস্ট রয়েছে ডেঙ্গু শনাক্তের। কাজেই রোগীদের এক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। যে টেস্টটি এই মুহূর্তে নেই, সেটিও খুব শীঘ্রই চালু হয়ে যাবে।'
জেলা, উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'ঢাকার বাইরে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকায় রোগীর ভিড় বাড়ছে। তবে মেডিকেল কলেজ থেকে ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকায় রেফার্ড করা হচ্ছে যা একদম ঠিক নয়। মেডিকেল কলেজে তো ডেঙ্গুর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে।'
'ডেঙ্গু মোকাবেলায় জেলা-উপজেলা থেকে সব পর্যায়ে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও ক্রিটিক্যাল এই তিনভাগে রোগীকে ভাগ করে চিকিৎসা দিতে হবে। ক্রিটিক্যাল রোগীদের শুধু মেডিকেল কলেজে পাঠাতে হবে। সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের মশারির মধ্যে রাখতে হবে এবং সম্ভব হলে হাসপাতাল নেট দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে', বলেন তিনি।
নোয়াখালী পল্লী উন্নয়ন সমিতির (এনআরডিএস) নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, 'নোয়াখালিতেও ধীরে ধীরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। জেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে টেস্টের সুবিধা এখনো কম, রোগীরা টেস্টের জন্য প্রাইভেটে যাচ্ছে। এখন গ্রামগঞ্জে যেহেতু ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু মোকাবেলায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আলাদা ইউনিট করে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।'
স্বাস্থ্য সচিব ডা. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'ডেঙ্গু অনেক জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অতিমাত্রায় ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত বছরগুলোতে দেখা যেত এটা মহানগরকেন্দ্রিক বেশি ছিল। কিন্তু এখন গ্রামগঞ্জেও ঢুকে পড়েছে। এটিই হচ্ছে বড় সমস্যা। সে কারণে রোগীর সংখ্যাটা বেশি। তবে হাসপাতালে আমরা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিলে আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধনের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।'