রাশিয়ার বড় অভিযানের জন্য মাঠ প্রস্তুত হচ্ছে!
ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে কিনা– সেকথা এখনই বলা হয়তো বাড়াবাড়ি হবে, কিন্তু দিনে দিনে এমন প্রমাণের স্তূপই ভারী হচ্ছে যে, দক্ষিণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে অক্ষম ইউক্রেনের সেনারা। লিমান, বাখমুত ও কুপিয়ানস্কের দিকে অগ্রসর হতেও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ছে তারা। এতে করে, যুদ্ধ এক চূড়ান্ত সমাপ্তির দিকে এগোনোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ঠিক একারণেই প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) কাছে ইউক্রেনের জন্য আরও ২০ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এ সহায়তার মাধ্যমে মূলত মানসিক শক্তি ফিরে পাবেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীও চাঙ্গা হবে।
যদিও এবার চাওয়া মাত্রই এত বিপুল অর্থ দিতে কংগ্রেস রাজি নাও হতে পারে। তাছাড়া, কেন ২০ বিলিয়ন ডলার দরকার- তা স্পষ্ট নয়। একইসময়, ব্যয়বহুল ও কঠিন এই যুদ্ধ অবসানের উপায় খুঁজে বের করার দিকেই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নাগরিক অভিমত। রাজনীতিবিদরাও যা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।
ইউক্রেনকে অস্ত্র, গোলাবারুদ যোগান দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মজুদে টান পড়ছে। এনিয়ে পেন্টাগনের উদ্বেগ তো আছেই। একইসঙ্গে, যুদ্ধ আরও দীর্ঘকাল চলার অস্বস্তি দেখা দিচ্ছে ওয়াশিংটনে। যে যুদ্ধে শেষপর্যন্ত বাজেভাবে হারের আশঙ্কা রয়েছে ইউক্রেনের। তখন সব চেষ্টাই হবে নিষ্ফল। যুদ্ধের পেছনে এত অর্থ, সম্পদ ব্যয়ের কোনো যুক্তিও থাকবে না। রিপাবলিকান শিবির এ যুক্তিতে বাইডেনের সমালোচনা করছে।
প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও, যুদ্ধে ইউক্রেনের আরও ব্যর্থতা তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। তখন কংগ্রেস আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ আর নাও রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে যুদ্ধের জন্য জনসমর্থন জোটানো যে আর সম্ভব হবে না, সে বিষয়টি অন্তত নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
এদিকে রাশিয়ার সামরিক তৎপরতার খবর সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষত কুপিয়ানস্কের কাছে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ধোঁয়াশা আছে। রুশরা তাদের অপারেশনকে আক্রমণ অভিযান বলছে না, কিন্তু অসমর্থিত কিছু সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে, এই এলাকায় অভিযানের জন্য অন্তত এক লাখ বা তারও বেশি সেনা জড়ো করেছে রাশিয়া। একইসঙ্গে, বিপুল পরিমাণ ভারি অস্ত্রও সেখানে সরিয়েছে।
যুদ্ধে রাশিয়ার বহুল ব্যবহৃত রকেট আর্টিলারি সিস্টেম হলো বিএম-২১ গ্রাড। সম্প্রতি গ্রাড লঞ্চারের একটি বহরকে কুপিয়ানস্কের দিকে যেতে দেখা গেছে।
এরইমধ্যে ইউক্রেনীয় সেনাদের কিছু ইউনিট লড়তে রাজি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এ ধরনের বিদ্রোহের ঘটনা কিয়েভ ধামাচাপা দিলেও– গতকিছু দিনে তা ঘটার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বাখমুত পুনর্দখলের আশা করছেন। ওয়াগনার বাহিনীর হাতে পতনের আগে এই শহরকে প্রতিরোধের দুর্গ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ফলে এর পুনর্দখল তার লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে। এই মুহূর্তেই অবশ্য ইউক্রেনীয় বাহিনীর হামলার ঝুঁকিতে নেই বাখমুত, তবে ইউক্রেনের সেনারা শহরের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের কিছু জনবসতি দখলের চেষ্টা করছে।
সবশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, উভয়দিকেই ইউক্রেনীয় সেনাদের অগ্রগতি রুখে দিয়েছে রুশরা। ফলে তাদের পিছু হটতে হয়। এতে বাখমুতের ধবংসস্তূপে বিজয় কেতন ওড়ানোর জেলেনস্কির স্বপ্ন আরো একবার ধুলিস্মাৎ হলো।
অন্য উপায় যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলেও জেলেনস্কির জন্য মাথাব্যথার কারণ হবে বাখমুতের নতুন লড়াই। এর আগে মিত্রদের দেওয়া বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম বাখমুতে নিয়োজিত করেছিল ইউক্রেন। সেনা হতাহতও হয়েছে অনেক। বাখমুতকে এত গুরুত্ব দেওয়ায় পশ্চিমারা ইউক্রেনের সমালোচনা করেছে। তাই সেখানে নতুন করে অস্ত্র বা সেনা খরচের পক্ষে তারা নয়।
এরমধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে অস্ত্র সহায়তা নিয়ে আসতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে চলেছেন জেলেনস্কি। তার জায়গায় যারা আসতে পারেন তাদের কেউই ততোটা অভিজ্ঞ নন, যুদ্ধ-পরিচালনার সাথেও নন তেমনভাবে সম্পৃক্ত।
অন্যদিকে, বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভকে যুক্তরাজ্যে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত করা হতে পারে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জেলেনস্কিকে সমর্থন করছে কিনা- তা কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না। কিন্তু, এরমধ্যেই কিয়েভ প্রশাসনে বিভাজন দেখা দিচ্ছে। এই অবস্থায়, নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা জেলেনস্কির জন্য একটি ভালো বাজি হতে পারে। কিন্তু, তা করলে জেলেনস্কির উৎখাতের সম্ভাবনাও আছে।
ইউক্রেন রিজার্ভ থাকা ইউনিটগুলোকে সমবেত করছে, যেগুলোর অনেকেই ন্যাটোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রুশ অগ্রযাত্রা রুখতে তাদের ব্যবহার করা হবে।
কিন্তু, তার ফলে আগামীতে সুপ্রশিক্ষিত ব্রিগেডের অভাব দেখা দেবে। কারণ, রাশিয়া চাইছে এসব ইউনিট হামলা করুক, যাতে দূরপাল্লার কামান, বিমান হামলা ও আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত মাইনের মাধ্যমে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা যায়।
আরো জানা যাচ্ছে যে, রাশিয়ার আক্রমণের মুখে যুদ্ধাঞ্চল থেকে নাগরিকদের গণহারে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে, রুশ বাহিনীর অগ্রগতি মন্থর করতে সড়ক ও সেতুগুলো বিস্ফোরক দিয়ে ধবংস করা হচ্ছে।
যুদ্ধের সম্মুখভাগ ব্যবস্থাপনায় রুশরা এপর্যন্ত যথেষ্ট চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছে। সে তুলনায়, কিয়েভে সীমিত পরিমাণে হামলা করেছে।
রাশিয়ার গণমাধ্যমে ভ্যালেরি জালুঝনি ও ওলেক্সান্ডার সিরস্কির মতোন শীর্ষ ইউক্রেনীয় কমান্ডারদের নিয়ে সামান্য আলোচনাই হয়েছে। তবে ইউক্রেনীয় বাহিনী পেশাদারিত্বের সাথে লড়ছে সেকথা স্বীকার করছে তারা। রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সাথে আলোচনার দ্বার খোলা রাখতে চায়, হয়তো এটা তারই ইঙ্গিত।
এদিকে, বেলারুশে অবস্থান করা ওয়াগনার সেনারা রাশিয়ায় ফিরে আসছে বলেও জানা যাচ্ছে। এর প্রাথমিক কারণ বেলারুশ সরকার ওয়াগনারকে তাদের সেনাদের বেতনভাতা ও নতুন যুদ্ধাস্ত্র কেনার অর্থ দিচ্ছে না।
এই সেনাদের অনেককেই আবার আফ্রিকায় পাঠানো হতে পারে। রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও নাইজারের অভ্যুত্থানকে সমর্থন না করলেও– সেই ঘোষণা হয়তো ওয়াগনার মার্সিনারিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। পশ্চিম আফ্রিকান দেশগুলোর জোট ইকোওয়াস সম্প্রতি 'নাইজারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায়' সামরিক অভিযানের যে পরিকল্পনা করছে– তা হয়তো রাশিয়া ও ওয়াগনারের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ইকোওয়াস জোটের সেনারা নাইজারের মতোই দুর্বল। তাদের যথেষ্ট পরিবহন, যোগাযোগ সরঞ্জাম ও রসদ নেই। তাই এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বহিরাগত কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ না থাকলে– তা গণহত্যার যুদ্ধে পরিণত হবে। বলা যায় না হয়তো পুতিন ওয়াগনারের সাবেক প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনকে সাদরে আফ্রিকায় পাঠাতে পারেন।
ঘটনা যেদিকেই মোড় নিক, নাইজারের পরিস্থিতি ইউক্রেনের বৃহত্তর রঙ্গমঞ্চেরই সাইড শো। কিন্তু, তার রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য। অনেকদিন ধরেই রুশরা শক্তি সঞ্চয় করছে, এই সময়ে তারা বড় আক্রমণ অভিযানে যায়নি। তাদের কৌশল ছিল, এর মাধ্যমে সামনে এগোতে আগ্রহী ইউক্রেনীয় বাহিনীকে আগে নাস্তানাবুদ করা, তাদের ক্লান্তশ্রান্ত করে তোলা। এই উদ্দেশ্যে তারা অনেকটাই সফল বলা যায়।
কিন্তু, মস্কোয় যুদ্ধ-পরিকল্পনাবিদেরা সময়ের হিসাব রাখতে জানেন। হয়তো বর্তমান সময়টাকেই তারা বড় আক্রমণ অভিযানের উপযুক্ত মনে করছেন। আর তা শুরু হলে, দৃষ্টি রাখতে হবে কুপিয়ানস্কে এরপর কী ঘটে তার ওপর।