বন্ধ থাকা ৩ মিল লিজ দিতে চায় বিটিএমসি
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেল থেকে সরে এসে এবার লিজ পদ্ধতিতে বন্ধ পড়ে থাকা মিল চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বিটিএমসি)। এক দশক ধরে চেষ্টা করেও পিপিপি মডেল সফল না হওয়ায় মিল তিনটি লিজ পদ্ধতিতে বেসরকারি খাতে দিতে চাচ্ছে বিটিএমসি।
চট্টগ্রামের ভালিকা উলেন মিলস, সিলেট টেক্সটাইল মিলস ও কুড়িগ্রাম টেক্সটাইলস মিলস বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন পেয়েছে সরকারি মালিকানাধীন এই কর্পোরেশন।
বিটিএমসির কর্মকর্তারা জানান, মিল তিনটিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ রয়েছে। কোনো ইউটিলিটি বিল, ভূমি উন্নয়ন কর কিংবা পৌর কর বকেয়া নেই। কোনো মামলাও নেই এই তিন মিলের।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ টিবিএসকে বলেন, পিপিপি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে বস্ত্রকল বেসরকারি খাতে দেওয়ার উদ্যোগের সফলতা বিশেষ নেই। সেজন্য লীজ পদ্ধতিতে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে, বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের(বিজেএমসি) বেশকয়েকটি মিল লিজ পদ্ধতিতে বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মামলা বা অন্য কোনো ধরনের ঝামেলা নেই এমন তিনটি টেক্সটাইল মিল লীজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "মিল তিনটি সফলভাবে লিজ দেওয়া সম্ভব হলে পিপিপিতে যেসব মিল বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা আছে, সেগুলোও লিজ পদ্ধতিতে আনা হবে।"
এর আগে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে বিটিএমসির বন্ধ মিল পিপিপি মডেলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় ও বিটিএমসি মিলে ১৬টি মিলের তালিকা তৈরি করে। এরপর ওই বছরেই অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ওই ১৬ মিল পিপিপি মডেলে পরিচালনার অনুমোদন দেয়। কিন্তু গত ১০ বছরে এ বিষয়ে উল্লেখ করার মত কোনো অগ্রগতি নেই।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ঠিক করে, লিজ দেওয়া মিল বস্ত্র ও পাট পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। লিজের মেয়াদ হবে ৩০ বছর। তবে সন্তোষজনক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে মেয়াদ নবায়নের সুযোগ থাকবে। মিলের বর্তমান যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা বা না করার সিদ্ধান্ত নেবেন লিজ গ্রহীতা। প্রয়োজনে লিজ গ্রহীতা নতুন অবকাঠামো স্থাপন করতে পারবেন। হস্তান্তরের আগে বিটিএমসি ও লিজ গ্রহীতা যৌথভাবে মিলের ইনভেন্টরি করবে। এসব মিলের লিজ গ্রহীতারা নিজের নামে ব্যবসা বা উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। ৩৬ মাসের নির্ধারিত মাসিক ভাড়ার সমপরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা জামানত হিসেবে গচ্ছিত রাখতে হবে। একইসঙ্গে, মিলের ফ্যাক্টরি ও গোডাউন বিল্ডিংয়ের ছাদে সোলার পার্ক স্থাপন করতে হবে। মিলের মালিকানা বা স্বত্ব থাকবে বিটিএমসির অনুকূলে।
বিটিএমসির পরিচালক(বাণিজ্য) হাওলাদার মো. রকিবুল বারী টিবিএসকে বলেন, এই মিলগুলোর লিজ পদ্ধতিতে বেসরকারি খাতে দেওয়া উপলক্ষে শনিবার (২৫ নভেম্বর) সিলেট ভ্রমণ করেছেন বিটিএমসির একটি প্রতিনিধি দল। সেখানে সিলেট চেম্বারসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সাথে মিলটি লীজ দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একইভাবে, অন্য দুটি মিলের জন্য চট্টগ্রাম ও কুড়িগ্রাম ভ্রমণ করা হবে। পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারণা চালানো হবে।
বিটিএমসি সূত্রে জানা গেছে, কেবল টঙ্গীতে অবস্থিত কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস পিপিপি মডেলে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহমেদ বাওয়ানি মিল হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া, সীতাকুণ্ডের আর আর টেক্সটাইল মিলস, রাজশাহী টেক্সটাইল মিলের দরপত্র মূল্যায়ন চলছে।
এছাড়া, ফেনীর দোস্ত টেক্সটাইল মিল ও মাগুরা টেক্সটাইল মিল পিপিপিতে চালু করার জন্য দরপত্র আহ্বানের কাজ চলছে। বাকি মিলগুলোর বিষয়ে এখনও কোনো উদ্যোগই নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রকিবুল বারী বলেন, পিপিপি প্রক্রিয়াটি বেশ ধীরগতির। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই আরও একাধিক মিল বেসরকারি খাতে হস্তান্তর হবে।
বিটিএমসির মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা নুরুল আলম টিবিএসকে বলেন, পিপিপি পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে আগ্রহী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক ঋণের জামানত হিসেবে মিলের জমিসহ অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করতে চান।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়া উদ্যোগ নেওয়া এবং অদক্ষতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে পিপিপি মডেল বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি জেনেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া বিবেচনা প্রসুত হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "পিপিপি মডেলের তুলনায় লিজ পদ্ধতি ভালো। লিজের মেয়াদ হতে হবে লম্বা। বিনিয়োগকারীকে তার সুবিধাজনকভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কারণ এসব মিলের জায়গা ছাড়া ভবন, মেশিন, শ্রমিক কিছুই রাখার অবস্থায় নেই। সবই নতুন করে করতে হবে। ফলে ব্যাপক বিনিয়োগ করে লাভ তুলতে যে সময় লাগবে, সে সময়টা বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে। তবে সরকারকে অবশ্যই কর্মসংস্থানের বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।"
স্বাধীনতা পর ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের অংশ হিসেবে ৭৪টি মিল জাতীয়করণ করা হয়। এসব মিল পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন(বিটিএমসি)। পরবর্তীতে বিটিএমটি আরও ১২টি মিল প্রতিষ্ঠা করে। এ নিয়ে বিটিএমসির মালিকানাধীন মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬টি। এক সময় সারা দেশে ১০৫টি বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিটিএমসির মিলগুলোতে উৎপাদিত সুতা ও কাপড় বিক্রি করা হত।
কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ধারাবাহিক লোকসানে পড়ে বিটিএমসি। একসময় কাঁচা তুলা আমদানি করতে না পারায় অধিকাংশ মিলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সংকটে পড়ে সরকার এক পর্যায়ে বিটিএমসির মিলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর বিটিএমসির অধীনে মিলের সংখ্যা কমে এখন ২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। এগুলোও ঠিক মত চালাতে পারছে না সংস্থাটি। প্রায় এক যুগ ধরে বেশিরভাগ মিল বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বন্ধ মিল পিপিপি মডেলে চালুর নির্দেশনা দেন। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটিও আশানুরূপভাবে এগোয়নি।
মিলগুলো বন্ধ থাকায় মিল থেকে বিটিএমসির কোনো আয় নেই। তবে কোনো কোনো মিলের ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা ভাড়া এবং ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত থেকে কিছু আয় হয়।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিটিএমসি ২৮.৬৯ কোটি টাকা আয় করেছে। এই সময়ে ব্যয় হয়েছে ৪৬.২৩ কোটি টাকা। ফলে লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৬.৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ লোকসানের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ইউটিলিটি বিল, ভূমি উন্নয়ন কর ও পৌরকর দীর্ঘমেয়াদে বকেয়া রয়েছে।