লোহিত সাগরের উত্তেজনা বিশ্বের ভঙ্গুর খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য খারাপ সংবাদ
লোহিত সাগরের উত্তেজনা কফি থেকে ফল সহ বিভিন্ন পণ্যের চালান ব্যাহত করতে শুরু করেছে। পাশাপাশি এটি ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া খাদ্য মূল্যস্ফীতির মন্থরতা কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
খাদ্যসামগ্রী বোঝাই জাহাজগুলি আফ্রিকার চারপাশে দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়েই হুথিদের আক্রমণ এড়াতে পারে। কিন্তু গ্যাস, তেল এবং ভোগ্যপণ্যের কার্গোগুলির বিপরীতে অন্যান্য পচনশীল খাবার বহনকারী কার্গোগুলোর সময় বেশী লাগার কারণে পণ্যগুলো বিক্রির অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটি খাদ্য ইন্ডাস্ট্রিকে একটি বড় ধাক্কা দিচ্ছে। ইতালীয় রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, এই পথে চলাচল করার জন্য কিউই এবং সাইট্রাস জাতীয় ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, চীনা আদার দাম বেশি হচ্ছে এবং কিছু আফ্রিকান কফি বহনকারী কার্গো কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত হচ্ছে। সুয়েজ খাল থেকে শস্য বহনকারী কার্গো জাহাজগুলো সরানো হচ্ছে এবং পশুসম্পদ বহনকারী কার্গোগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য পথ পরিবর্তন করছে।
যদিও এই প্রভাব এখন পর্যন্ত সীমিত, এটি খাদ্য সরবরাহ কতটা ভঙ্গুর হতে পারে তার একটি নির্দেশক। যদি এই সমস্যা আরো তীব্র হয় তাহলে খাদ্যপণ্যের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে যেখানে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল।
লোহিত সাগরে বাধা ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে
ভারতীয় প্রধান আঙুর রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউরো ফ্রুটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিতিন আগরওয়াল বলেন, "এখানে সবারই ক্ষতি হয়েছে।" প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত লোহিত সাগর দিয়ে ইউরোপে পণ্য পরিবহণ করে। তবে এখন দীর্ঘ রুট ব্যবহার করার কারণে পণ্য পরিবহণ খরচ চারগুণ এবং ট্রানজিট সময় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগরওয়াল বলেন, এর ফলে আঙ্গুরের গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় আমদানিকারকরা ভারতীয় আঙুর উচ্চ মূল্যে ক্রয় করতে সম্মত হয়েছে যা ভোক্তাদের ভোক্তাদের খরচ আরো বাড়াবে। ইউরোপিয়ান ফ্রেশ প্রোডাক্ট অ্যাসোসিয়েশন ফ্রেশফেল অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণত আঙ্গুরের চাহিদার প্রায় সপ্তমাংশের জন্য ভারতের উপর নির্ভর করে এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে এই চাহিদা ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ইতালীয় রপ্তানিকারকরা যারা এশিয়াতে প্রায় ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কৃষি পণ্য বিক্রি করে তারা উদ্বিগ্ন যে আফ্রিকা হয়ে ঘুরে যাওয়া ফলের সতেজতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ফার্ম গ্রুপ কনফ্যাগ্রিকোল্টুরার প্রেসিডেন্ট ম্যাসিমিলিয়ানো জিয়ানসান্টি বলেছেন, এর ফলে আপেল, কিউই এবং সাইট্রাস জাতীয় ফলের খরচ বাড়বে।
এটি কৃষকদের জন্যও চিন্তার কারণ যেহেতু উচ্চ শিপিং খরচ মেটাতে তাদের দাম কমাতে হতে পারে।
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আঙুর চাষি সন্দীপ দাগু সন্ধন বলেন, "আমাদের দাম কমে গেলেও বিক্রি করতে হবে কারণ আমরা ফসল কাটার সময়কাল দীর্ঘায়িত করতে পারি না। রপ্তানিকারকরা সবসময় তাদের খরচ মেটাতে চেষ্টা করে। দাম কমে গেলে আমাদের ক্ষতি হবে।"
দীর্ঘ উদ্বেগের বিষয়
কৃষি-খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করা সিইএলসিএএর তথ্যমতে, শিপিং সমস্যার কারণে ইউরোপে শুকরের মাংস, দুগ্ধ এবং ওয়াইনের মতো পণ্যের রপ্তানির পাশাপাশি চা, মশলা এবং হাঁস-মুরগির আমদানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদিও এর প্রভাব কেমন তা এখনো স্পষ্ট নয়। গোয়েন্দা সংস্থা কেপলার জানিয়েছে, সুয়েজ খালের দিকে রওনা হওয়া প্রায় ১.৬ মিলিয়ন টন শস্য বহনকারী জাহাজগুলোকে সাম্প্রতিক সপ্তাহে অন্য রুটে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফসল নিয়ে যাচ্ছিল।
ইউকে গ্রোসারি জায়ান্ট টেসকো পিএলসি সতর্ক করেছে যে, শিপিংয়ের ব্যাঘাতের ফলে কিছু পণ্যের মূল্যস্ফীতি হতে পারে। জে সেন্সবারি পিএলসি দেরি মোকাবেলায় সরকারের সাথে কাজ করছে।
পূর্ব লন্ডনের নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেটে ডিসেম্বর থেকে তাজা আদার দাম এক তৃতীয়াংশের বেশি বেড়েছে। পাইকারি বিক্রেতা আমের সুপারফ্রেশ লিমিটেডের মুহাম্মদ প্যাটেল বলেছেন, সরবরাহকারীরা দীর্ঘ সমুদ্র ভ্রমণের জন্য খরচ বাড়াচ্ছে।
প্যাটেল বলেন, "প্রতিদিনই আমাদের দেরি হয় কিন্তু এরকম কিছুই এর আগে হয়নি।"
কিছু ব্যবসায়ী কার্গো বিলম্বিত করেছেন। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক কফি আমদানিকারক মার্কেন্টা পূর্ব আফ্রিকায় সংক্ষিপ্তভাবে পণ্য জাহাজে তোলা বন্ধ করে দিয়েছে কারণ এই রুটে চলাচলের জন্য এখন অনুমতির প্রয়োজন। যদিও মার্কেন্টা
আবার পণ্য লোড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কোনও বিলম্ব ইউরোপে পণ্য বিক্রির হার এমন এক সময়ে কমিয়ে দিবে যখন আমেরিকার চালানগুলো পানামা খাল সহ অন্যান্য স্থানে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে।
মার্কেন্টার প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্টিফেন হার্স্ট বলেছেন, "যদি একটি কার্গো দক্ষিণ দিকে যায় তাহলে এটিকে খুব দীর্ঘ ট্রানজিটে যেতে হবে এবং সম্ভবত তাতে আরো খরচ বাড়বে।"
উগান্ডা এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি ইউরোপের কফির অন্যতম বড় আমদানিকারক এবং লোহিত সাগর এই বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।
যদিও পচনশীল খাবারগুলো প্রায়ই কন্টেইনারে পরিবহণ করা হয়, ভিয়েতনাম কফি কোকো অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, কিছু কোম্পানি কফি পাঠানোর জন্য বিশাল ক্যারিয়ার ব্যবহার করা শুরু করেছে। এটি বন্দরের মতো জায়গায় পণ্য সরবরাহ কঠিন করে তুলতে পারে এবং পণ্যগুলোর আরো ক্ষতি করতে পারে।
পাকিস্তান থেকে আসা গোলাপি লবণ ক্রেতাদের বেকায়দায় পড়ার আরেকটি উদাহরণ। শাহপুর ইন্ডাস্ট্রিজের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপক মজিদ মাহবুব পরচা বলেন, তার গ্রাহক সংখ্যা কমে গেছে কারণ ক্রেতারা উচ্চ পরিবহণ খরচ দিতে নারাজ। ইউরোপে কনটেইনার পাঠানোর খরচ স্বাভাবিকের থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, "আমাদের কাছে পণ্য আছে কিন্তু ক্রেতারা যদি পণ্য পরিবহণের খরচ দিতে রাজি না হয়, আমরা তাদের বাধ্য করতে পারি না।"