একদিনের আয়োজনে অন্যতম জটিল নির্বাচন: ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন নিয়ে যা যা জানা দরকার
সংখ্যাটা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।
১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ ভোট দেবেন। তাদের অনেকেই প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। কয়েক হাজার দ্বীপ থেকে, কয়েকটি টাইম জোনে ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন তারা। এর মধ্য দিয়েই নির্বাচিত হবেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। এদিন দেশজুড়ে থাকবে সাধারণ ছুটি। আর প্রায় ৭৫ শতাংশ যোগ্য ভোটার ভোট দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকরা এবার সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও নির্বাচন করবেন।
এবারের নির্বাচনি মৌসুম আশঙ্কা জাগিয়ে দিয়েছে, কয়েক বছর আগেও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থাকা ইন্দোনেশিয়ায় সেই কালো অতীত ফিরে আসবে। এ আশঙ্কা ছড়িয়ে পরেছে দেশটির বাইরেও। বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা, নিকেল ও পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া। জলবায়ু পরিবর্তন সংকটে দেশটির বড় ভূমি রয়েছে।
আর এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রভাব বিস্তারের দ্বৈরথে ইন্দোনেশিয়াকে 'সুইং স্টেট' হিসেবে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর অধীনে চীনের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার সম্পর্ক অনেকটাই গভীর হয়েছে। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন।
ইন্দোনেশিয়ার এবারের নির্বাচনের নিয়ে কিছু কথা জানা দরকার।
ঝুঁকিতে আছে কী?
পাঁচ বছরের দুই মেয়াদ শেষে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন জোকো উইদোদো। এবারের নির্বাচন তাই তার উত্তরসূরি বাছাইয়ের ভোট।
জোকোউই নামেও পরিচিত ইন্দোনেশিয়ান প্রেসিডেন্ট। ইন্দোনেশিয়াকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম সফল অর্থনীতিতে পরিণত করার কারণে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। তিনি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করেছেন, নির্মাণ করেছেন ১ হাজার মাইলের বেশি সড়ক-মহাসড়ক। তার শাসনামলে দেশটির বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ করে।
সমর্থকেরা বলছেন, উইদোদোর কাজ হয়নি। বৈষম্য ও দারিদ্র্যের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করা বাকি আছে তার।
সমালোচকেরা বলছেন, অবকাঠামো নির্মাণ ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি জোকো উইদোদো গণতান্ত্রিক রীতিনীতিও ভেঙেছেন। এখন ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরও তিনি নিজের প্রভাব বিস্তার করার জন্য কৌশল সাজাচ্ছেন।
এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে জোকো উইদোদো সম্ভবত একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তোকে সমর্থন দেবেন। সুবিয়ান্তোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে। তাই উইদোদোর সমর্থকদের একাংশও তাকে নিয়ে আতঙ্কিত। এ নির্বাচনের ফল জনসংখ্যার দিকে থেকে বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে কারা?
১৫ বছরে এই প্রথম ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তিনজন প্রার্থী পেয়েছেন: বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোয়ো, জাকার্তার সাবেক গভর্নর আনিয়েস বাসওয়েদান ও সেন্ট্রাল জাভার গভর্নর গাঞ্জার প্রানোয়ো।
এক বছর আগে অনেকেই উইদোদোর রাজনৈতিক দলের প্রার্থী গাঞ্জারকেই সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট ভেবেছিলেন। কিন্তু অনূর্ধ্ব-২০ বিশকাপে অংশ নিতে ইসরায়েলকে ইন্দোনেশিয়ায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ভূমিকা রাখায় তার সুনাম হোঁচট খায়। এ সিদ্ধান্তের ফলে ইন্দোনেশিয়া ওই আসর আয়োজনের অধিকার হারায়।
এরপর অক্টোবরে উইদোদোর এক আত্মীয় কনস্টিটিউশনাল কোর্টে এক আইন পরিবর্তনের জন্য সিদ্ধান্তমূলক ভোট দেন। ওই আইন বদলের ফলে প্রেসিডেন্টের ৩৬ বছর বয়সি ছেলে গিবরান রাকাবুমিং রাকা ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে লড়ার সুযোগ পান। এর আগে ৪০ বছরের কম বয়সি কেউ এ পদের জন্য লড়তে পারত না। এতে জোকো আদালতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছেন, এমন ধারণা গেঁড়ে অনেকের মনে।
আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রাবোয়োকে নিয়েও ভোটারদের মধ্যে বিভেদ আছে। যদিও তিনি জোকোর নীতিমালাগুলোকে 'সব মানুষের জন্য খুব, খুব উপকারী' বলে আখ্যা দিয়ে আসছেন। তবে অনেক ইন্দোনেশিয়ানদের কাছে তিনি তিন দশকের একনায়ক সুহার্তোর প্রতীক। প্রাবোয়ো বিয়ে করেছিলেন সুহার্তোর এক মেয়েকে। এছাড়া সুহার্তোর সেনাবাহিনীতেও জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ওই সেনাবাহিনী ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত। ১৯৯৮ সালে প্রাবোয়োকে শিক্ষার্থী অধিকারকর্মীদের অপহরণের নির্দেশ দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জরিপ বলছে, নির্বাচনে প্রাবোয়ো অনেক এগিয়ে থাকবেন। তবে তিনি ৫০ শতাংশের বেশি কিংবা ২০ প্রদেশের অন্তত ২০ শতাংশ ভোট পাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। এ পরিমাণ ভোট পেলে তিনি জুনে রানঅফ ভোট এড়িয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন।
গাঞ্জারও জোকোর নীতির সিংহভাগই অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাকে 'জোকো লাইট' অভিধা দেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গাঞ্জার তার বার্তা স্পষ্টভাবে দিতে হিমশিম খেয়েছেন। আর জরিপ বলছে, তার সমর্থন ২০ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে।
এ নির্বাচনি দৌড়ে আনিয়েসকে দেখা হচ্ছিল পিছিয়ে পড়া তৃতীয় প্রতিযোগী হিসেবে। সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় রেক্টর আনিয়েসকে বড্ড বেশি বিদ্বান মনে করা হতো। ধারণা করা হতো, সাধারণ মানুষ তার বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে পারবে না। ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম বাস্তবায়ন ও করোনা মহামারি সামাল দেওয়ার জন্য জাকার্তার অনেক মানুষ তার ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। তবে কট্টর ইসলাম প্রচারকদের সঙ্গে পূর্ব-সংযোগের কারণে অনেক ভোটার তার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছেন।
তবে গত কয়েক সপ্তাহে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া আনিয়েস ভালো সমর্থন পেয়েছেন। সম্প্রতি কয়েকটি বিতর্কে তার পারফম্যান্সের খুশি হয়েছেন জেন-জি ও শহরাঞ্চলের শিক্ষিত ভোটাররা। আনিয়েস বলেছেন, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী অন্য একটি দ্বীপে সরিয়ে নিলে সুষম উন্নয়ন হবে না। এছাড়া তিনি স্বজনপ্রীতি ফিরে আসতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ২২ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে গাঞ্জারের চেয়ে এগিয়ে আছেন আনিয়েস।
ইন্দোনেশিয়ায় ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮। আর মোট ভোটারের অর্ধেকেরই বয়স ৪০-এর নিচে। জরিপ বলছে, তরুণ ভোটাররা অর্থনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দুর্নীতি অপসারণ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এবারের নির্বাচন কেন আলাদা?
এবারের নির্বাচন বিশ্বের সবচেয়ে জটিল একদিনের নির্বাচনগুলোর একটি। প্রায় ১৭ হাজার দ্বীপ (৭ হাজারের মতো দ্বীপে মানুষ বাস করে) নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২০৫ মিলিয়ন মানুষ নিবন্ধিত ভোটার।
ছয় মিলিয়ন নির্বাচন কর্মকর্তা গোটা দেশ ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছেন যত বেশি সম্ভব মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে। কিছু জায়গায় লজিস্টিকস বড় সমস্যা। কর্মকর্তা ঘোড়ায় চেপে, নৌকায় করে, হেলিকপ্টারে চড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেক করে ওইসব জায়গায় ভোটারদের কাছে পৌঁছেছেন।
ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন আয়োজন এক মহাযজ্ঞ।
ভোটাররা নখ বিঁধিয়ে ব্যালটে ছাপ মারবেন। নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, এটাই কলম ব্যবহারের চেয়ে তুলনামূলক ভালো পদ্ধতি, কারণ অনেক ইন্দোনেশিয়ানই লেখার সরঞ্জামের সঙ্গে পরিচিত নন। ভোট গণনার সময় কর্মকর্তারা ব্যালট কাগজ উঁচিয়ে ধরেন, যাতে নখ দিয়ে করা ফুটো দিয়ে আলোর পারাপার সবাই দেখতে পায়।
ভারতে জাতীয় নির্বাচন হয়ে কয়েক সপ্তাহ হয়ে, কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় হয় একদিনে। ২০১৯ সালে এ কাজ এমনই জগদ্দল পাথর হয়ে ওঠে যে ৮১৯ জন নির্বাচন কর্মী মারা যান কাজের চাপে। তাই সরকার এবার স্বেচ্ছাসেবীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট গণনা শেষ হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে গেলেও ফলাফল সাধারণত দিন শেষেই জানা হয়ে যায়।