জুম মিটিংয়ের নামে লুটপাটের মহোৎসব!
কোডিড-১৯-এর কারণে স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও অর্থ যোগান দিতে সরকার যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সময়ে অনলাইন কর্মশালায় (জুম অ্যাপ) চলছে সরকারি অর্থের লুটপাট।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ৭২ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন ও নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষায় এ অনিয়ম করা হচ্ছে। অনলাইনে কর্মশালা হলেও অংশগ্রহণকারীদের ব্যাগ, ফোন্ডার, কলম, প্যাডের বদলে দেওয়া হয়েছে নগদ টাকা। এ খাতে প্রতিটি কর্মশালায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা করে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা দেওয়া হয় কর্মকর্তাদের।
মজার বিষয় হলো, এসব কর্মশালায় আইএমইডির প্রথম শ্রেণির সব কর্মকর্তা ৭২টি করে ব্যাগ, কলম, ফোল্ডার, প্যাডের জন্য টাকা পেয়েছেন। হিসাব করে দেখায়, আইএমইডির প্রতি কর্মকর্তা এ খাত থেকে আয় করেন ১ লাখ ১৫ হাজার ২০০ টাকা করে।
অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই নিজ বাসা থেকে বৈঠকে অংশ নিলেও খাবার বিল এসেছে ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। টেকনিক্যাল ও স্টিয়ারিং কমিটির তিনটি করে মিটিংয়ের দুটি করে জুম অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে খরচ ১৪ লাখ ৪০ হাজার। সব মিলিয়ে অনলাইনে মিটিংও খাবার খরচ হয়েছে ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
স্টেশনারি ও অন্যান্য ব্যয় হিসেবে ১০ লাখ ৮০ হাজার খরচ দেখিয়েছে আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগ পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
কয়েকটি বিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনলাইনে হওয়ার কারণে এবার প্রতিটি কর্মশালায় ১২০ অংশগ্রহণকারীকে দিতে হয়নি প্রতিবেদনের হার্ড কপি। কিন্তু অনেক প্রকল্পের ১২০ কপির জন্য ১৫ হাজার টাকা করে বিল তোলা হয়েছে। অবশ্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পের এ বিল করা হয়নি। যদি ৫০টি প্রকল্পও এ বিল করে, তাহলে এ খাতে খরচ হয়েছে ৭ লাখ ৫০ টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) রাজস্ব খাত থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ প্রভাব মূল্যায়ন ও নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করে। সমীক্ষার মূল কাজ ফেব্রুয়ারিতে শুরু করে গত জুনে শেষ হয়েছে। আইএমইডির আট সেক্টেরের প্রতিটি থেকে ৯টি করে প্রকল্প বাছাই করা হয়। এর আগের অর্থবছরে ৪৭টি প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন ও নিবিড় পরিবীক্ষণ করেছিল আইএমইডি।
আউটসোর্সিংয়ে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, আইএমইডি তাদের বিলের একটি ফরম্যাট দিয়েছে, তারা সেভাবে বিল করে জমা দিয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, ৭২টি প্রকল্পের জন্য একই নিয়মে বিল করার শর্ত দিয়েছিল আইএমইডি। ফলে সবার সব বিল খরচ একই ধরনের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানান, জুমে মিটিং হয়েছে। খাবার বিলের ডকুমেন্ট আইএমইডি থেকে আমাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটি এখনো না দেওয়ায় বিল জমা দিতে পারছি না।
আইএমইডির মহাপরিচালক আফজল হোসেন বলেন, জুমে মিটিং হবে, এ কারণে সুবিধা কমানো হবে- তা তো বলা হয়নি। ফলে সোর্সিংয়ের নিয়মাবলির মধ্যে যা যা ধরা ছিল, সেটাই খরচ করা হচ্ছে। বাড়তি কোনো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না।
কর্মকর্তাদের সম্মানী
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা ভ্যাট ও উৎস কর বাদ দিয়ে ১২০০ টাকা করে পেয়েছেন। ফলে কর্মশালা থেকে আইএমইডির কর্মকর্তারা সম্মানী বাবদ আয় করেছেন ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা।
আইএমইডিতে এখন প্রথম শ্রেণির ৭৩ কর্মকর্তা সব কর্মশালায় অংশ নিতে পারেন। কর্মশালায় অংশ নিন বা না-নিন, সব কর্মকর্তাই এ সম্মানী পেয়েছেন। এছাড়া আইএমইডি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, পরিকল্পনা কমিশন এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্মকতা এবং কিছু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এতে অংশ নেন।
আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মোঃ ফয়েজউল্লাহ, অতিরিক্ত সচিব এবং মহাপরিচালকদের আয় বেশ চোখ কপালে তোলার মতো। কর্মশালার প্রধান অতিথি ভ্যাট বাদ দিয়ে সম্মানী পেয়ে থাকেন ৫ হাজার ৯৯০ টাকা। এছাড়া বিশেষ অথিতি ও সভাপতি, মুখ্য আলোচকের সম্মানী ৫ হাজার ২৫০ টাকা। বেশির ভাগ সময় প্রধান অতিথি ছিলেন আইএমইডি সচিব। মাঝে মধ্যে তিনি সভাপতিও ছিলেন। ফলে কর্মশালা থেকে তার আয় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা।
আউটসোর্সিং কার্যক্রমের মনিটরিং কাজে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক হলেন আইএমডি সচিব। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য তিন করে মোট ২১৬টি স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয়। অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুয়ায়ী স্টিয়ারিং কমিটির সব সদস্যের সম্মানী ২ হাজার টাকা করে। ভ্যাট বাদ দিয়ে সেটি দেড় হাজার টাকা করে দাঁড়ায়। ফলে এখান থেকে সম্মানী হিসেবে সচিবের নিচ আয় তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা। আপ্যায়নভাতা থেকে তিনি পেয়েছেন ৫ লাখ টাকারও বেশি।
প্রকল্পে সহায়ক জনবল, অর্থাৎ আইএমইডির যেসব কর্মচারী এ কার্যক্রমে সহায়তা করেছেন, তাদের অনেককে এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সহায়ক জনবলের জন্য প্রতি প্রতিবেদন পিছু ৭৫ হাজার টাকা করে মোট ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সবার মধ্যে সেটি ভাগ করা হয়েছে বলে আইএমইডির এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। আইএমইডির প্রশাসন প্রতি প্রকল্পে এ খাত থেকে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়েছে। এই ১৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার মূল অংশ পাবেন সচিব এবং কিছু অংশ পাবেন অতিরিক্ত সচিব।
পরামর্শক সভায় থেকে অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের আয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে ভ্যাট বাদ দিয়ে শুধু সম্মানী বাবদ তিনি মোট আয় করেছেন তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা। অ্যাপায়ন ভাতা হিসেবেও স্টিয়ারিং কমিটির সভা থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি আয় করেছেন তিনি।
আইএমইডি দপ্তর থেকে জানানো হয়, সচিব তার প্রাপ্য থেকে ১৫ লাখ টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত দিয়েছেন।
আইএমইডির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইএমইডি কর্মকতারা সারা বছর এই টাকার আশায় বসে থাকে। চাইলেই এটা কমানো সম্ভব নয়। যেমন ব্যাগ, ফোন্ডার, কলম, প্যাট খাতের টাকা বাদ দেওয়া উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এবার লকডাউনের পরের মিটিংগুলোর জন্য খাবারের যে বিল ধরা হয়েছে, সচিব তা ফেরত পাঠাচ্ছেন। যদিও আইএমইডির বিভিন্ন সেক্টর থেকে এটা পাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এর আগে অর্থবছরে ব্যবস্থাপনা সার্ভিস নামে প্রতিটি প্রকল্পে দেড় লাখ টাকা করে ধরা ছিল। সচিব এবার সেটি বাদ দিয়েছেন। ফলে ডিজি থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তার আয় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। এ নিয়ে কর্মকর্তারা নাখোশ।
ব্যবস্থাপনা সার্ভিস থেকে বাদ দেওয়া হলেও এবার সহায়ক জনবল খাতে প্রতি প্রকল্পে ৩০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। ব্যাগ, ফোন্ডার, কলমেও ব্যয় কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া সম্পাদনা প্যালেন খাতে প্রতি প্রকল্পের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। সেক্টরগুলো কর্মকর্তারা এ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এবার ৩৬ লাখ টাকা আইএইডির কর্মকর্তারা ভাগ করে নিচ্ছেন।
প্রভাব মূল্যায়ন ও নিবিড় পরীবিক্ষণের মূল কাজ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় এবং মার্চে মূলত কোভিড-১৯ আসার পরই সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। ওই সময় স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। কারণ, লকডাউনের দুই মাসে দেশের সব পরিবহণ বন্ধ ছিল। ফলে এ খাতে মোট ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রভাব মূল্যায়ন ও নিবিড় পরীবিক্ষণের কাজ যথাযথ তদরকির জন্য আইএমইডি সচিব ও সেক্টরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং ও একটি টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে। কিন্তু এ কমিটির একটি করে সভার পরই মার্চে কোভিডের কারণে লকডাউন শুরু হয়। ফলে বাকি দুটি করে সভা অনলাইনে করতে হয়। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের কমিটির সদস্যদের সম্মানি দুই হাজার টাকা। ভ্যাট বাদে এটা কমে দেড় হাজার টাকায় দাঁড়ায়।
টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যদের সম্মানী এবং আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় হয়েছে মোট ৫২ লাখ ৯২ হাজার টাকা। সেক্টরের মহাপরিচালক এ কমিটির আহ্ববায়ক। সদস্যাসংখ্যা ১১। শুধুমাত্র এ খাত থেকে প্রতি সদস্য সম্মানী ও আপ্যায়ন ভাতা পেয়েছেন ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা করে।
দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পের সঙ্গে বেড়ে যায় বরাদ্দের আকার। ফলে জনবল সংকটের অজুহাতে ২০১০ সালে আইএমইডি চালু করে আউটসোর্সিং।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইএমইডির বিভিন্ন সেক্টেরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে। স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক অভিজ্ঞরা কাজ পাচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা না থাকায় প্রতিবেদনে যথাযথ ফলাফল উঠে আসছে না। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে প্রতিবেদনে যে সুপারিশ দেয়, সেগুলো কখনো কার্যকর হতেও দেখা যায় না বলে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন।