ছাগল-কাণ্ডের মতিউরের এত সম্পদ! বিশ্বাস হচ্ছে না এলাকাবাসীর
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/06/26/matiur_rahman_home_0.jpg)
সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। বাড়ি ও এলাকার খোঁজখবর মোবাইলের মাধ্যমেই সারতেন। বড় ভাইয়ের ঢাকার সম্পত্তি দেখভালের ব্যস্ততায় মেজ ও ছোট ভাইও গ্রামে তেমন আসতেন না। গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করেন চাচাতো ভাইয়েরা।
দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের গ্রাম ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেল। বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে তার পৈতৃক বাড়ি। গ্রামে অবশ্য মতিউর রহমান নামে কেউ তাকে চেনেন না। চেনেন হাকিম মাস্টারের ছেলে পিন্টু হিসেবে।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) সকালে এ গ্রামের বিভিন্ন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। গ্রামবাসী এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যিই কি পিন্টুর এত সম্পদ আছে!
মতিউর রহমান বছরের পর বছর ধরে রাজস্ব কার্যালয়ে তার ঊর্ধ্বতন পদের অপব্যবহার করে আর্থিক ও রিয়েল এস্টেট সম্পদসহ কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পিন্টুর সম্পদ নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে ধোঁয়াশা থাকলেও বাহাদুরপুর গ্রামের হাকিম হাওলাদারের বাড়ির চাকচিক্য এখন স্পষ্ট। গ্রামের যেকোনো সিদ্ধান্তও পিন্টুকে জানিয়ে নেওয়া হয় বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রতিবেশী।
তিনতলা একটি মাদ্রাসা আর দোতলা মসজিদের মাঝখানে মিনারবিশিষ্ট লম্বা তোরণের মধ্যদিয়ে বাড়ির প্রবেশ পথ। মতিউর রহমানের দুই চাচাতো ভাই মাহমুদ্দুন্নবী ও ফখরুদ্দিন এখন এ বাড়ির তত্ত্বাবধান করেন।
মাহমুদ্দুন্নবীর বিশ্বাস, বড় মিয়াঁর নামে যা বলা হচ্ছে তার সবই ষড়যন্ত্র; তিনি এত সম্পদের মালিক নন। পিন্টুর সম্পদ 'তারই পরিশ্রমে' গড়া। 'স্কুলজীবন থেকে আমরা দেখে এসেছি, তিনি [মতিউর] হিসেবি লোক। এক টাকা বেহিসেবে খরচ করতেন না।'
মতিউর রহমান যখন স্কুলে পড়তেন, তখন থেকেই ছাগল পালন করতেন বলে জানান মাহমুদ্দুন্নবী। 'ছাগল পালতেন, বড় করতেন। সেই টাকা জমাতেনও,' বলেন এ চাচাতো ভাই।
মতিউরের দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান ইফাত ১৫ লাখ টাকা খরচ করে গত ঈদুল আজহার সময় একটি ছাগল কিনেছেন — এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন মতিউর রহমান।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/06/25/matiur_rahman_0.jpg)
মাহমুদ্দুনবীর কাছ থেকে জানা গেল, প্রথম জীবনে অর্থসংকট ছিল মতিউরের। বাবুগঞ্জে খালার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি।
তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার বড় মতিউর ওরফে পিন্টু। কাজীরচরে ভালো স্কুল না থাকায় এবং মতিউর রহমান মেধাবী ছাত্র হওয়ায় খালার বাড়িতে পাঠিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিল পরিবার। মাহমুদ্দুন্নবীর ধারণা, তার বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে 'লোক লেগেছে'।
মতিউরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন ফখরুদ্দিনও। 'আমরা তো তার বংশের। এত টাকাই যদি তার থাকত, অন্তত আমরা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারতাম। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বড় মিয়াঁ নির্দোষ প্রমাণিত হবেন,' বলেন তিনি।
তবে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মতিউর রহমান এলাকায় কয়েক একর জমি-বাড়ি গড়েছেন, ভাইকে ঢাকায় ব্যাগ কারখানা খুলে দিয়েছেন বলেও স্বীকার করেন ফখরুদ্দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় পৌনে দুই একর জমির ওপর মতিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি। ফসলি জমি রয়েছে ২০ থেকে ৫০ একরের মতো।
গত ৪ জুন মতিউরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে দেখা যায়, গাজীপুরের পুবাইলে মতিউর রহমানের নামে ৫৫ বিঘা জমি, একটি পার্ক, আরও ৩০০ বিঘা জমি, একটি জুতার কারখানা, দামি গাড়ি এবং তার বা তার আত্মীয়স্বজনের নামে বাড়ি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, মতিউরের মেজ ভাই কাইয়ূম হাওলাদার ওয়ার্ড বিএনপির রাজনীতি শুরু করলেও মতিউর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই ঢাকার টঙ্গী এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগ তৈরির কারখানা খোলেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে আরও কিছু ব্যবসা রয়েছে তার।
অন্যদিকে মতিউরের ছোট ভাই নূরুল হুদা ঢাকায় থেকে ব্যবসা করলেও এলাকায় তার নামে নতুন কোনো সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মতিউরের বাবা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল হাকিম শিক্ষকতা পেশা থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসরের পর কাজীরচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুলাদী উপজেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক ইউসুফ আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
মতিউর রহমান ১১তম বিসিএসে ট্রেড ক্যাডারে সরকারি চাকরি শুরু করেন। তবে ট্রেড ক্যাডার বিলুপ্ত হলে রাজস্ব ক্যাডারে যোগ দেন তিনি। সেখানে যোগ দিয়ে আস্থা অর্জন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের।
দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরুর পর মতিউরকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
২৪ জুন ঢাকার একটি আদালত মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী এবং তাদের সন্তানের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একইদিন মতিউরকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণের জন্য সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৫ জুন) মতিউর, তার দুই স্ত্রী ও সন্তান এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাংক হিসাব ৩০ দিনের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ওইদিন মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের বেনিফিশিয়ারি ওনার অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব) জব্দ করতেও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।