কেতলি জাহাঙ্গীর: চা দোকানি থেকে যেভাবে ‘৪০০ কোটি টাকার পিয়ন’
ছিলেন মিরপুরের চা দোকানি। রাজনৈতিক সভা সমাবেশে পল্টন এলাকাতেও চা-পানির দোকান নিয়ে বসতেন বলে শোনা যায় জেষ্ঠ্য রাজনীতিবিদদের মুখে। চা বিক্রি করতেন বলে লোকজন ডাকতো 'কেতলি জাহাঙ্গীর' নামে। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলেও তাকে এই নামেই চেনেন গ্রামবাসীরা।
চাটখিলের স্থানীয় বাসিন্দা ও জাহাঙ্গীর আলমকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড । তারা জানান, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দেয় জাহাঙ্গীর আলমের। এর আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেন।
গ্রেনেড হামলার দিন পল্টন থাকার সুবাদে নিজে আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন। একই সাথে আহত অনেককে হাসপাতালে নেওয়ার কাজও করেছেন, এমন ছবি তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন, যাতায়াত বাড়ে পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কপাল খুলে যায় জাহাঙ্গীর আলমের।
নিজের বাসার এক কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে— কে এই ৪০০ কোটি টাকার মালিক পিয়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে 'কেতলি জাহাঙ্গীর' ওরফে 'পানি জাহাঙ্গীর'। তার বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল থানাধীন খিলপাড়া ইউনিয়নে। বাবা মৃত রহমত উল্ল্যাহ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন 'সুধা সদনে' ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। সেসময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেওয়া হতো, সেটা এই জাহাঙ্গীর বহন করতেন। এজন্যই তিনি 'পানি জাহাঙ্গীর' হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাটখিলের সেই জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে নানান তদবির করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি; নোয়াখালী ও রাজধানী ঢাকায় গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করছেন— এমন অভিযোগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনে নিকটস্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতেও বলা হয়।
বিপুল সম্পদের বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপন করেছেন।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার
সূত্র জানায়, কোটি কোটি টাকার সম্পদ কামানোর পর রীতিমতো রাজনৈতিক মাঠে নেমে যান পিয়ন জাহাঙ্গীর। চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য নমিনেশন তুলেছিলেন। পরে নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তবে পরবর্তীতে তিনি নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান।
সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তিনি নোয়াখালীতে বিপুল অর্থও খরচ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশাল বহর নিয়ে তিনি সভা-সমাবেশ করতেন। এসব সভা-সমাবেশের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন তিনি। যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে নোয়াখালী ও জেলার চাটখিল উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহাঙ্গীর। জেলা সাংবাদিক নিয়োগেও ছিল জাহাঙ্গীরের হাত। ফলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি সব দপ্তরে বিশেষ কদর পেতেন জাহাঙ্গীরের নির্দেশে নিয়োগ পাওয়া ওই সাংবাদিকরা।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর চাটখিলের খিলপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে তিনবার তার ভাইয়ের নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চাটখিল পৌরসভার মেয়র হওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি তার অনুসারী মোহাম্মদুল্লাহকে সাহায্য করেছিলেন।
বিপুল সম্পদ
সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে ২,৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া, নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে তার ৮ তলা একটি বাড়ি রয়েছে। সেটিও তার স্ত্রীর নামে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার। ঢাকার মিরপুরে একটি সাত তলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষিখাত থেকে তার প্রতিবছর আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা আয়, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা আয়, চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
এছাড়া, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা ছিল হলফনামার তথ্য অনুযায়ী। ডিপিএস ছিল পৌনে তিন লাখ টাকা, এফিডিআর ছিল সোয়া এক কোটি টাকা। স্ত্রীর আছে ছিল গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এছাড়া, একটি অংশীদারী প্রতিষ্ঠানে তার ছয় কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীরের ব্যাংক হিসাবের খোঁজ-খবর নিচ্ছে বিএফআইইউর একটি টিম। রোববার (১৪ জুলাই) বিএফআইইউ থেকে দেশের সব ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।