ঢামেক হাসপাতালে আহতদের সারি: সহিংসতার ভুক্তভোগী অসহায় মানুষ
ছুটির দিনে ফুটবল খেলতে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়েছিল ১১ বছরের আলিফ। এমন সময় গোলাগুলির আওয়াজে বন্ধুরা যে যার মতো দৌড় দেয়। আলিফ দৌড়াতে যাবে, ঠিক তখনই একটি গুলি লাগে তার পায়ের পাতায়। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পড়ে যায় সে।
গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাজধানীর রামপুরার পলাশবাগের মোড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার মাঝে শতাধিক আহতদের একজন মোহাম্মদ আলিফ। সে রামপুরা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র।
বর্তমানে ঢাকা মেডিকলে কলেজের ক্যাজুয়ালটি ব্লকের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছে আলিফ। ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, 'তার পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।'
আলিফের মা আসমা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি জানতাম ছাত্ররা নাকি কী নিয়ে আন্দোলন করছে, এজন্য আলিফের স্কুল ছুটি। সে বাসাতেই থাকত, আশেপাশের ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলত, আর আমি কাজে যেতাম।'
আসমা বেগম জানান, ২০২১ সালে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার চর বাহাদুরপুর গ্রাম থেকে স্বামী কামরুল ইসলামের সঙ্গে ভাগ্য পরিবর্তনে ঢাকার রামপুরায় উলন বাজারে বসবাস শুরু করেন তারা। আসমা কয়েকটি বাসাবাড়িতে কাজ করতেন, কামরুল ইসলাম ড্রাইভার। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার।
সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয় রামপুরাসহ আশেপাশের এলাকায়। আসমা বেগম কাজ শেষে বাসায় ফিরে শোনেন, ছেলে আলিফের পায়ে গুলি লেগেছে।
আসমা বলেন, 'সেদিন দুপুর ২টায় আলিফ ফুটবল খেলতে আরও ৫-৬ জনের সঙ্গে বাইরে বের হয়। এর মধ্যে রামপুরার পলাশবাগের মোড়ে সবাই মিলে করমচা পাড়তে যায়। এ সময় গন্ডগোল বাধলে সবাই দৌড়ে পালালে সে-ও সরে আসার চেষ্টা করে। এ সময় তার পায়ের পাতায় গুলি লাগে। তাৎক্ষণিক আঙুলগুলো ঝুলে যায়।'
আসমা আরও বলেন, 'রাস্তার মানুষেরা আমার বাবুটারে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে গুলি বের করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠায়। এখানে সাত দিন আছি, ধারদেনা করে ইতিমধ্যে প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে।'
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আলিফ বলে, 'ফুটবল খেলা আমার খুব পছন্দের, কিন্তু আমি গত সাত দিন হাঁটতে পারিনি। সবাই আমার পাশ হেঁটে যাচ্ছে সেটা দেখছি। আমার ইচ্ছা, বন্ধুদের সঙ্গে আবারও ফুটবল খেলব আর দৌড়াব।'
এদিকে ১৮ জুলাই দুপুরে বগুড়ার সাতমাথার রেলওয়ে মার্কেটে পুলিশের গুলিতে এক চোখ হারান ৪৫ বছর বয়সি মোস্তফা কামাল। প্রথমে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩০৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মোস্তফা কামাল বলেন, 'রেলওয়ে মার্কেটের কেচিগেটের সামনে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ হঠাৎ করে মার্কেটের ভেতরে গুলি শুরু করে। এ সময় দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একটি গুলি আমার ডান চোখে লাগে। কিছুক্ষণ পরেই আমার চোখ ঝরে পরে, আর গুলিটা নাকের মাঝ দিয়ে মুখে চলে আসে। এখনো চোখে ও মুখে রক্তক্ষরণ হয় মাঝেমধ্যে।'
মোস্তফা কামালের ছেলে রিজওয়ান জান্নাত রিয়াদ বলেন, 'গত বৃহস্পতিবার রাত ২টায় আমরা ঢামেকে পৌঁছাই। তখন থেকে আমাদের প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। টাকা লেনদেনেও সমস্যা হচ্ছিল, এরপরেও কষ্ট করে আত্মীয়-স্বজনরা টাকা পাঠিয়েছে। ঢাকায় এসে দেখি আব্বার মতো শতাধিক মানুষ ৩০৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে।'
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) বিকেল চারটা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডেথ রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা যায়, গুলিবিদ্ধ আহতদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুজন মারা গেছেন। এদের একজন ময়মনসিংহের নন্দাইল থানার ১৭ বছর বয়সি জামান মিয়া, সে উত্তরার আজমপুরে আহত হয়। অপরজন জাকির হোসেন (২৯); তিনি রায়েরবাগে দর্জি হিসেবে কাজ করতেন, সেখানে রাস্তা পারাপারের সময় গুলিতে আহত হন।
সবমিলিয়ে বৃহস্পতিবারের দুটি নিয়ে ঢামেকে এখন পর্যন্ত ৮৬ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। তবে আহতের সুনির্দিষ্টি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত একাধিক ডাক্তার ও নার্স।
ঢামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহে বিভিন্ন স্থানের সংঘর্ষে আহত শতাধিক গুলিবিদ্ধ মানুষ বেডে ও ফ্লোরে চিকিৎসা গ্রহণ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স বলেন, গত পাঁচ দিনে প্রায় ৬০০ গুলিবিদ্ধ মানুষ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ চিকিৎসা শেষে ফিরে গেছে।