‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না, মা, শেষবার একটু জল দাও, মা!’
'দাদা, আমি তো শেষ। আমাকে গুলি করছে, দাদা। অনেক কাকুতি-মিনতি করছি, …আমার কোনো কথা শোনেনি। বলছি আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি, তা-ও আমার কলার ধরে রাস্তায় টেনে এনে পেটে বন্দুক ঠেকায়ে গুলি করছে দাদা।'
গত ২০ জুলাই ঢাকার সাভারে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে এভাবেই মায়ের নম্বরে ফোন করে বড় ভাইকে নিজের অবস্থার কথা জানান তরুণ পোশাক শ্রমিক শুভ শীল (২৪)।
শুভ শীল আশুলিয়ার চক্রবর্তী এলাকার কে এ সি ফ্যাশন লিমিটেডে সুইং অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার। তিনি ঝিনাইদহ জেলার সদর থানাধীন মনোরিয়া গ্রামের বিকাশ শীলের ছেলে। পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার জিরানি বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। পরিবারের দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভই ছিলেন ছোট।
গত ২০ জুলাই বিকালে ঢাকার সাভারে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন শুভ। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোর ৫টা ৪ মিনিটের দিকে শুভর মৃত্যু হয়।
'আমার নিরপরাধ ছেলেটা পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও কেন আমার ছেলেকে গুলি করা হলো?' প্রশ্ন করেন শুভ শীলের মা সাধনা শীল।
শুভর পরিবার জানায়, করোনাকালীন সময়ে এসএসসি পাশ করার পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে মা আর ভাইয়ের সঙ্গে শুভ নিজেও বছরখানেক আগে পোশাক কারখানায় যোগ দেন।
ঘটনার আগের দিন ধামরাইয়ে মামার বাসায় বেড়াতে যাওয়াই শুভর জন্য কাল হয়েছিল বলে মনে করছেন শুভর মা সাধনা শীল।
সাধনা শীল নিজেও একজন পোশাক কর্মী। তার অপর ছেলে সোহাগ শীলও শুভর সঙ্গে কে এ সি ফ্যাশনের কাটিং সেকশনে কর্মরত আছেন। পরিবারের কর্তা শুভর বাবা বিকাশ শীল ছাড়া বাকি সবাই পোশাক কর্মী। বিকাশ শীল জিরানি এলাকায় একটি সেলুনের দোকান চালান।
'সেদিন (২০ জুলাই) রাত ৮টা নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছাই আমরা। গিয়ে দেখি আমার বাচ্চাটা বেডে পড়ে কাতরাচ্ছে। কাইন্দা কাইন্দা কয়, মা, আমি আর বাঁচব না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটু জল চাইছিল বাচ্চাটা আমার কাছে। বলছিল, মা, আমাকে একটু জল দাও। খুব কষ্ট হচ্ছে, মা, আমার। শরীর অবশ হয়ে আসছে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না, মা। শেষবার একটু জল দাও, মা। আমি আমার বাচ্চাটার মুখে শেষবার এক ফোঁটা জলও দিতে পারিনি, ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছি। ডাক্তাররা বলছিলেন জল দেওয়া যাবে না। সেই যে গেল অপারেশনের থিয়েটারে, আর আমার ছেলেটা ফিরল না,' কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই ছেলের শেষ মুহূর্তের কথাগুলো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানাচ্ছিলেন শুভ শীলের মা সাধনা শীল।
তিনি বলেন, 'আমরা কোনো রাজনীতির মধ্যে নেই, আন্দোলনের মধ্যে নেই। …কলার ধরে টেনে নিয়ে আমার ছেলেকে গুলি করেছে। কী দোষ ছিল আমার ছেলের? আমার ছেলের পেট ফুটো হয়ে গুলি ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে, কী কষ্টটাই না হয়েছে আমার মানিকের! আমি আমার বুকের মানিকের হত্যার বিচার চাই।'
সাধনা শীল জানান, শুভ গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বেলা ১২টার পর জিরানির বাসা থেকে ধামরাইয়ের চৌঠাইল এলাকায় তার মামার বাসার উদ্দেশে রওনা হন। শুক্রবার রাতে মামার বাসাতেই ছিলেন শুভ।
পরদিন ২০ জুলাই শনিবার বিকাল ৪টা নাগাদ মামার বাসা থেকে বের হয়ে আশুলিয়ার জিরানির নিজের বাসার উদ্দেশে রওনা হন শুভ। পথিমধ্যে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আটকা পড়েন তিনি।
এ সময় গোলাগুলির মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে পাশের একটি মার্কেটে আশ্রয় নেন শুভ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময়ই গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থাতেই শুভ তার মায়ের নম্বরে ফোন করে নিজের অবস্থার কথা জানান। পরে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার পড়ে থাকার পর আশপাশের লোকজন সন্ধ্যায় শুভকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোর ৫টা ৪ মিনিটে মারা যান শুভ।
শুভর বড় ভাই সোহাগ শীল টিবিএসকে বলেন, 'গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শুভ ওই অবস্থাতেই রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় মায়ের নম্বরে ফোন দেয়। তখনও শুভর জ্ঞান ছিল। মায়ের ফোন তখন আমার কাছে। আমি ফোন রিসিভ করলে শুভ জানায়, গন্ডগোলের মধ্যে সাভার বাস স্ট্যান্ড এলাকায় আটকা পড়েছিল সে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে একটি মার্কেটে আশ্রয় নেয় শুভ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মার্কেট থেকে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলে রাস্তায় ফেলে শুভর পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। আমি তখন শুভকে বলি, যেভাবে পারিস আশেপাশের লোকজনকে বলে হাসপাতালে যা, আমরা আসছি। এরপর শুভ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।'
ঘটনার বিষয়ে শুভর সেই মুহূর্তের কথাগুলো ছিল এমন—'দাদা, আমি তো শেষ। আমাকে গুলি করছে দাদা। অনেক কাকুতি-মিনতি করছি, আমার কোনো কথা শোনেনি। বলছি আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি, তা-ও আমার কলার ধরে রাস্তায় টেনে এনে পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করছে দাদা।'
শুভর মামা বাসুদেব বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, 'শুক্রবার বিকাল থেকে শুভ আমার বাড়িতে। শনিবার দিন বিকাল আনুমানিক ৪টা নাগাদ বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয় সে। আমাদের এখান (চৌঠাইল) থেকে তো সাভার নামাবাজার হয়েই যাতায়াত করতে হয়। এরপরই এই ঘটনা।'
সাধনা শীল বলেন, 'রাস্তায় গাড়ি না চলার কারণে ভেঙে ভেঙে অনেক কষ্টে রাত ৮টা নাগাদ আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে যাওয়ার পর ছেলের জন্য রক্ত জোগাড় করি অনেক কষ্টে, কারণ কেউ সে সময় এই পরিস্থিতির মধ্যে বের হতে পারছিল না, দেশে কারফিউ। একদিকে রক্ত দেয়, আরেকদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন রাতে শুভকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর সেখান থেকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অপারেশনের পর আর আমার মানিক কথা বলেনি।'
সাধনা শীল বলেন, 'ঝিনাইদহে একটু ভিটামাটি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নাই আমাদের। আশুলিয়ার জিরানি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি সবাই। দুই ছেলে আর আমি নিজেও গার্মেন্টসে চাকরি করি, আশা ছিল সবার আয়ে টাকা জমায়ে বাড়িতে একটা ঘর দিব। আমার পুরো সংসারটা এলোমেলো করে দিল তারা।'