চালু হওয়া ইন্টারনেট সংযোগ আইসিটি পেশাজীবীদের জন্য কতটুকু সহায়ক হয়েছে?
হাইলাইটস
- আপলোডিং ও ডাউনলোডিং স্পিড অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না
- তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ব্যবসার কার্যক্রম কমেছে ৭০-৮০ শতাংশ
- চলে যাচ্ছে বিদেশি গ্রাহকরা
- বাধামুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারের জন্য আইসিটি পেশাজীবীদের বিদেশে যেতে হচ্ছে
- ভবিষ্যতে ইন্টারনেট আবারও বন্ধ না হওয়ার প্রতিশ্রুতি চায় আইসিটি খাত
ইন্টারনেট সংযোগ কেন বন্ধ হয়েছিল, অথবা মানসম্পন্ন সংযোগ কেন এখনও চালু হয়নি – এসব বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়- বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ অব্যাহত আছে। এই যন্ত্রণা আরও বেশি আইসিটি (তথ্যপ্রযুক্তি) খাতের পেশাজীবীদের। স্বাভাবিক ও বাধামুক্ত কার্যক্রমে ফিরতে মরিয়া দশা যেন তাঁদের।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান– এএসএল বিপিও। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি মর্টগেজ প্রসেসিং কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি আউটসোর্সিং চুক্তি জেতার শেষপর্যায়ে ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বাংলাদেশি বংশদ্ভূত আমেরিকান ও শীর্ষ ব্যবস্থাপক ঢাকার কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতেও আগ্রহী ছিলেন।
এএসএল বিপিও'র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জায়েদ আহমেদ বলেন, 'বার্ষিক ১৮ মিলিয়ন ডলার রেভিনিউয়ের চুক্তিটির জন্য আমরা ১৫০ জনের টিম নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু, ২৯ জুলাই চুক্তি থেকে পিছিয়ে যায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি। কারণ, হিসেবে বলে দেয়, তারা আমাদের এখানকার ইন্টারনেট সংযোগের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না।'
জায়েদ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বিএসিসিও)'র বৈশ্বিক বাজার উন্নয়ন বিষয়ক উপ-কমিটিরও কো-চেয়ার। তিনি আরও বলেন, 'এক কথায়, বিদেশি কোম্পানিটি এখন বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকেই নির্বাচন করছে না।'
বৈশ্বিক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানকে সেবাপ্রদানকারী ডিজিটাল মার্কেটিং ফার্ম– ডিজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা অ)সিইও এইচ এম হামিদুজ্জামান বলেন, 'ইন্টারনেটের মন্থর গতির কারণে আমাদের প্রোডাক্টিভিটি ইতোমধ্যেই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে গেছে।'
হামিদুজ্জামানের ১৬ জনের টিম ঢাকায় থেকে কাজ করে। ২০১৯ সাল থেকে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ই-কমার্স কোম্পানিকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল মার্কেটিং সলিউশন্স সংক্রান্ত সেবা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ২.৫ মিলিয়ন (২৫ লাখ) ডলার আয় করছে।
তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, 'আমার ভয় হচ্ছে এখন এত ভালো কনট্র্যাকটা আমরা হারাব।' বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়ে বিদেশি গ্রাহকটি তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল বলেও জানান তিনি। তিনি ইন্টারনেট ফেরার পরে ইন্টারনেটের স্পিড বা অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে তারা আরও কোনো সমস্যার কথা শুনতে বা বুঝতে চাইছে না, অথচ দেশের আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিনিয়ত এসব সমস্যার সাথে যুঝতে হচ্ছে।
হামিদুজ্জামান বলেন, 'আমাদের বেশিরভাগ কাজই হয় ক্লাউড সার্ভিসের মাধ্যমে, যার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট থাকা একেবারেই অপরিহার্য। কারণ বড় বড় সাইজের অনেক বেশ কয়েকবার করে ডাউনলোড ও আপলোড করতে হয়।' তিনি আরও জানান, ওয়েব বা অ্যাপ ইন্টারফেস তৈরির জন্য ফিগমা'র মতো ওয়েব-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন লোড করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। এদিকে ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে অনেক সময়েই লোডিংয়ের আগেই টাইমআউট হয়ে যাচ্ছে। ফলে একটা কাজ করতেও তার টিমকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
'এভাবে প্রফেশনাল কাজ করা যায় না। অনেক কোম্পানিই বিদেশি ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে তাঁদের টিমকে পাঠাচ্ছে, যেখানে নির্বিঘ্ন ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি রয়েছে' - তিনি যোগ করেন।
হামিদুজ্জামানের সাথে সহমত প্রকাশ করে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোস্যাইটির চেয়ারপার্সন তানজিবা রহমান বলেছেন, গ্রাফিক বা ভিডিও ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের যে কাজ করতে একঘণ্টা লাগতো– এখন সেগুলোতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগছে।
বিএসিসিও'র চেয়ারম্যান ওয়াহিদ শরীফ বলেছেন, সেবা প্রদানের অঙ্গীকার অনুযায়ী, তা দিতে না পারায় দেশের অনেক আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এখন তাঁদের বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের থেকে চাপের মধ্যে রয়েছে। নিজেদের অনলাইন সেবাগুলোর আউটসোর্সিং কাজ দেওয়ার আগে – ইন্টারনেট নিয়ে আর সমস্যা হবে না– বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে এর নিশ্চয়তা বা নির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতিও চায়।
বাংলাদেশে এখাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। অনলাইন উদ্যোক্তারা বলছেন, এরমধ্যে নির্বিঘ্ন ও দ্রুতগতির সংযোগ জীবনদায়ী ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু, সাম্প্রতিক উত্তাল সময়ে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহতের ঘটনা তাঁদের দুর্ভোগই কেবল বাড়িয়েছে।
ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি ও ফ্রিল্যান্সাররা বৈশ্বিক গ্রাহকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংক্রান্ত সেবাও দেন। কিন্তু, এখন দেশে ফেসবুক ব্যবহার করতে না পারায়– তারা রয়েছে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে। তারা বলছেন, বিকল্প উপায় হলো– ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহার করা, কিন্তু পেশাদারী কাজের জন্য যে দ্রুতগতির প্রয়োজন হয়– সেটার জন্য ভিপিএন উপযুক্ত সমাধান নয়।
শুধু আইসিটি পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররাই নন, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকছে ইন্টারনেটের সমস্যায়। স্থানীয় হোক বা বহুজাতিক– এ থেকে মুক্ত নয় কেউই। ইন্টারনেট সংযোগের পর্যাপ্ত গতি না থাকায় দৈনন্দিন কাজগুলো করতেই নাকাল অবস্থা হচ্ছে আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানেও।
বিজিএমইএ'র সাথে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে পোশাকের আন্তর্জাতিক বায়ার ও ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ধীর গতির ইন্টারনেটের কারণে তাঁদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অর্ডার কনফার্মেশনের ডকুমেন্ট যুক্ত করে পাঠাতে পারছেন না তারা। চালান ও অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত দরকারি নথিপত্র জমা দিতেও সমস্যা হচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর – গত ১৮ জুলাই রাত ৯টা থেকে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, তার আগে একইদিনে বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট সেবা।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গত ১৮ জুলাই জানান, সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন কন্টেন্ট পোস্ট করে সহিংসতায় উস্কানি প্রদান রোধে সরকার মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অবশ্য পরে তিনি দেশব্যাপী সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জন্য কিছু ইন্টারনেট অবকাঠামো ও ফাইবার অপটিক কেবলে নাশকতা ও ভাঙচুরকে দায়ী করেন।
হামিদুজ্জামানের মতো উদ্যোক্তারা বলছেন, টিকে থাকতে ও আরও বিকশিত হতে, তাঁদের তিনটি জিনিস অত্যন্ত দরকার, – জরুরি সেবা হিসেবে স্বীকৃতি, বিশেষ ইন্টারনেট সংযোগ এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই আর ইন্টারনেট সীমাবদ্ধ করা হবে না– কর্তৃপক্ষের এমন বিশ্বাসযোগ্য ঘোষণা।