ফরিদপুরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখনো আতঙ্কে
ফরিদপুরের সদর, মধুখালী, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলার হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে এইসব হামলা ঘটতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই পালিয়ে যান।
গত সোমবার দুপুরের পরে প্রথম হামলার চেষ্টা করা হয় ফরিদপুর পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বিপুল ঘোষের বাসায়। তার বাসা ফরিদপুর শহরে গোয়ালচামট ১নং সড়কে। প্রথমেই হামলাকারীরা তার বাড়ির প্রধান গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে দুই তলায় তার রুমে ঢোকার প্রধান দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। এসময় ভিতর যারা ছিলেন তারা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে– হামলাকারীরা পরে সেখান থেকে চলে যায়।
এরপরেই ফরিদপুর শহরের সিংপাড়ায় ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোসের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। এসময় এলাকাবাসী প্রতিহত করে তাদের সেই চেষ্টা।
ওইদিনই ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতেও হামলার চেষ্টা করা হয়।
একইদিনে ফরিদপুরের সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামে দিপু ঘোষের বাড়িতে বিএনপিপন্থীরা হামলার চেষ্টা করে বলে জানা গেছে। পরে সেখানে ঢুকতে না পেরে– তারা চলে যায়। এদিন ওই বাড়ির লোকজন রাতে ভয়ে বাড়ির পাশে ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয়। এখনো ওই বাড়ির লোকজন আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন।
শহরের ঝিলটুলি কালিবাড়ি এলাকায় ফরিদপুর পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক অজয় রায়ের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করে একদল দুর্বৃত্ত। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, মারধর ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে।
আর এসব কারণে ফরিদপুর সদর উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে মধুখালীতে আতঙ্কে ভুগছেন হিন্দু পরিবারের নারী ও শিশুরা। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মেগচামি ইউনিয়নের বামুন্দি গ্রামে ৫ আগস্টের পালাবদলের সুযোগে ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে পল্লী চিকিৎসক উত্তম কুমার রায় ও তার ভাই গৌতম কুমার রায়ের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। তাদের পারিবারিক মন্দিরেও ভাঙচুর করা হয়।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় একজন স্কুলশিক্ষকের ইন্ধনে তারই নেতৃত্বে এ হামলায় অংশ নেয় শতাধিক লোক। অনেককে তারা চিনেন না।
এ ঘটনার পরে পরিবারটির নারী ও শিশুরা আতঙ্কে রয়েছেন। মধুখালী উপজেলার মেগচামি ইউনিয়নের বামুন্দি বাজার ও গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
অভিযোগ রয়েছে, বামুন্দি-বালিয়াকান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাচ্চু মোল্লার ইন্ধন ও নেতৃত্বে মূল ভুমিকায় ছিলেন– বামুন্দি বালিয়াকান্দি গ্রামের আবু বক্কর মোল্লার ছেলে হাসান মোল্লা, মোল্লাডাঙ্গী গ্রামের মোকা মোল্লার ছেলে আমিরুল মোল্লা, বামুন্দি-বালিয়াকান্দি গ্রামের হাসান শেখের ছেলে আজমল শেখ, মোল্লাডাঙ্গী গ্রামের মান্নান শেখের ছেলর মামুন শেখ, বামুন্দি-বালিয়াকান্দি গ্রামের রশিদ মিয়ার ছেলে নয়ন মিয়া। অন্তত শতাধিক লোক এই ভাঙচুর-লুটপাটে অংশ নেয় এবং হত্যার হুমকি দিয়ে যায়।
একই দিনে বাগাট ইউনিয়নের বাগাট বাজার এলাকায় অর্চনা বসুর একটি কাপড়ের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দোকানটি বাগাট-নওপাড়া সড়কে অবস্থিত। হামলার পর ভাঙচুর ও লুটতরাজ করা হয়েছে ইউনিয়নের সিতারামপুর গ্রামে অবস্থিত স্কুলশিক্ষক সঞ্জয় কুমার দাসের বাড়িতে। হামলা করা হয়েছে বাগাট বাজারে অবস্থিত রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডার দোকানে।
মধুখালী-নওপাড়া সড়কের কাছে বিপ্লব সাহার একটি ময়দার মিলে হামলা করে ভাঙচুর করা হয়েছে।
এছাড়া সদরপুর উপজেলার হাট কৃষ্ণপুর বাজারে সুবীর কুমার সাহার একটি বড় ওষুধের দোকান এবং তরুণ সাহার মুদি দোকানে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। ওই দিন রাতে এ ঘটনা ঘটে হাটকৃষ্ণপুর বাজারে। এরপর থেকে দোকানের মালিক সুবীর কুমার সাহা পালিয়ে বাড়ি ছাড়া রয়েছেন বলে তার এক আত্মীয় জানিয়েছেন।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার কলারন গ্রামে জোর করে গাছ কাটার অভিযোগ করেছেন গৌতম কুমার রায় নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমার পৈতৃক জমির বড় গাছ জোর করে সাত্তারসহ তার লোকজন কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাকে হুমকি দিয়ে বলে গিয়েছে, 'এ দেশ তোদের না।'
এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার পৌরসদরের নওপাড়া গ্রামে সংখ্যালঘু এক পরিবারের সদস্যের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার সকালে ওই গ্রামের অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ পলান (৭৫) এর ওপর সংঘবদ্ধ হামলা করা হয়। ওইদিন সকালেই তাকে আহত অবস্থায় ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। বয়োবৃদ্ধ ওই সদস্যকে পিটিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম করা হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অমরেন্দ্র কুমার জানান, সকালে আমার বাড়ির কাছে নির্মল ঠাকুরের দোকানে বসেছিলাম। তখন আমার নিকট প্রতিবেশী বাবুল মিয়া, মিনহাজ মিয়া, হাসান মিয়াসহ ৬/৭ জন সংঘবদ্ধ হয়ে আমার ওপর হামলা চালায়।
এভাবে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আরো কিছু হামলা, ভাঙচুর ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটলেও অনেকে তা বলতে ভয় পাচ্ছেন বলে জেলা পূজা কমিটির এক নেতা জানিয়েছেন।
এদিকে শুক্রবার সকালে ফরিদপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন ফরিদপুর জেলায় দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাহিদুল আমিন শেখ। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে ফরিদপুর হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ আশ্বাস দেন।
এসময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সেনা কর্মকর্তাকে জানানো হয় জেলার সার্বিক পরিস্থিতি। এসময় কর্নেল নাহিদুল আমিন ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনেছেন, এবং পরিস্থিত উত্তরণে দরকারি ভূমিকা নেওয়ার কথা জানান।
এবিষয়ে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াছিন কবির বলেন, ফরিদপুরে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব এলাকায় সেনাবাহিনী তাদের টহল জোরদার করেছে বলেও তিনি জানান।