আন্দোলন-অস্থিরতায় বড় লোকসানে বগুড়ার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন বগুড়ার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। কর্মীদের বেতন ও দৈনন্দিনের ব্যবসায়িক খরচ মেটাতে এখন বিপাকে পড়েছেন অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিক।
"গত এক মাস ধরে বগুড়া শহরের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর শহরের অবস্থা অনেকটা থমথমে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিক্রি নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষও সেভাবে খেতে বের হন না। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রতিদিনই খুলে রাখতে হচ্ছে; বিদ্যুৎ পুড়ছে; সঙ্গে আছে অন্যান্য খরচ। সব মিলিয়ে এক মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা আরও অবনতি হবে," নিজের ব্যবসায়ের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন নারী উদ্যোক্তা তাহমিনা পারভীন শ্যামলী।
বগুড়া শহরের শেরপুর সড়কে রোচাস হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের অন্যতম পরিচালক তিনি। এই নারী উদ্যোক্তা জানান, রেস্টুরেন্টে বিক্রি না হওয়ার কারণে বর্তমানে কর্মচারীদের খাবার দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমন অবস্থা শুধু রোচাসের নয়, শহরের অধিকাংশ রেস্টুরেন্টেরই। উত্তরবঙ্গের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র বগুড়া হওয়ার কারণে এখানে প্রায় ভালো মানের শতাধিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক মাসে তাদের বিক্রি অন্ততপক্ষে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এতে ১০০টি হোটেলে লোকসান হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
বগুড়া শহরের ইয়াকুবিয়া মোড় ও কালী মন্দির এলাকায় বারবিকিউ নামের দুটি রেস্টুরেন্ট আছে। দুটির মালিক আব্দুল বাছেদ। গত এক মাসে তার দুই প্রতিষ্ঠান মিলে অন্তত ১৭ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এই মাসের শেষের দিকে এসেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় তিনি শঙ্কায় রয়েছেন।
এই ব্যবসায়ী জানান, "দুই রেস্টুরেন্ট মিলে ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজনের পিছনেই প্রতিমাসে ৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের কাছে ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে।"
বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর নতুন সরকার দেশ পরিচালনা করছে, এরপরও কেন এমন শঙ্কা জানতে চাইলে আব্দুল বাছেদ বলেন, "আমার কাস্টমার বগুড়াসহ আশপাশের জেলার। তারা রাত আটটার পরে বগুড়ায় এসে খেয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই। মানুষ এখন রাস্তায় বের হতে ভয় পায়। কিন্তু আমরা তো প্রায় প্রতিদিনই প্রস্তুতি নিয়ে কাস্টমারের জন্য বসে থাকি।"
গত মাসের শেষের দিকে বিক্রি কিছুটা থাকলেও চলতি মাসে তা কমে ৫ শতাংশে নেমেছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার শহরের ম্যাক্স মোটেলে অন্যতম পরিচালক জিএম সাকলায়েন বিটুল।
তিনি জানান, "রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বগুড়ায় নতুন করে কোনো গেস্ট আসেননি। অফিস আদালতেও কাজের গতি আগের মতো নেই। আগে ১০০ টাকা বিক্রি হলে এখন ৫ টাকার লেনদেন হচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। সব মিলে মানুষ অপেক্ষা করছে, কবে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। আমরাও সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছি।"
বগুড়ার শহরের একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট রানার প্লাজায় নারী ব্যবসায়ীদের দ্বারা চালিত ফুডকোর্ট সম্ভবনাময় ছিল। কিন্তু করোনা সয়ে উঠলেও বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এই সমীকরণ কিছুটা পাল্টে গেছে। বগুড়ার একমাত্র শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত রানার প্লাজার ৭তলায় ১৭টি রেস্টুরেন্ট মিলে গড়ে উঠেছে ফুটকোর্ট। এখানকার বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টের মালিকই নারী উদ্যোক্তা; পরিচালনাও করেন তারা। কিছুদিন আগেও এই মার্কেটে প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেলেও এখন লোকজন তেমন নেই বললেই চলে। ফলে ফুডকোর্টের ব্যবসায়ীরা এখন স্টাফদের খাবার, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বগুড়া শহরের মালতিনগরের বাসিন্দা মালিক বিপাশা খাতুন ফুডকোর্টে 'চিল ক্যাফ' নামে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক। বিপাশা জানান, রানার প্লাজায় তিনটি দোকান ঘরের জন্য তাকে প্রতিমাসে ৩৩ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। বর্তমানে পরিস্থিতিতে কাস্টমার তেমন না আসলেও নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল, সার্ভিস চার্জ, ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে।
"কাকস্টমারের আশায় থেকে ঘরে জমানো টাকা ব্যবসার পেছনে খরচ করেছি। ঋণের বোঝায় বেকায়দায় রয়েছেন অনেকেই। মার্কেটে লোকজন না আসলে ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় থাকবে না," যোগ করেন তিনি।
ফুডকোর্টেরর ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই মার্কেটে দিনে গড়ে সাড়ে তিন লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়েছে। ক্রেতায় ভরপুর থেকেছে পুরো ৭তলা। তবে এখন গোটা মার্কেট মিলে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার খাবার বিক্রিও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
গত সাত বছর ধরে বগুড়ায় খাবারের ব্যবসা করছেন সুমা'স কিচেনের মালিক সাবিনা সুলতানা। বর্তমান পরিস্থিতি ও ব্যবসা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "আসলে মানুষের আয় কমে গেছে। আমাদের রেস্টুরেন্টে আসে মানুষ শখ করে খাবার খেতে। এখন শখের খাবারকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। দেশে কখন কী হয়, বলা যায় না।"
"একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যের দামও বেড়েছে। দেশের এক শ্রেণির মানুষের কাছে টাকা আছে। তারা শান্তিতে থাকলেও সবার মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে। এসব কারণে আমদের ব্যবসার দিনকাল খারাপ যাচ্ছে," বলেন তিনি।
বগুড়া জেলা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান নিশাদ বলেন, "করোনার পর ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ালেও বর্তমানে আবারও তারা সংকটে পড়েছেন। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ছেন। এই পরিস্থিতিতে তাদের টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।"
ব্যবসায়ীদের ঋণদান সম্পর্কে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, "সরকারের স্বল্প সুদে বিভিন্ন ঋণদান কর্মসূচি রয়েছে। কেউ আবেদন করলে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে তাকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।"