এমপক্স ভাইরাস: আতঙ্ক নয়, সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই মোকাবিলা করতে হবে
সম্প্রতি আফ্রিকার কয়েকটি দেশে আশঙ্কাজনকভাবে এমপক্স বা মাংকি পক্সের সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াসহ বিশ্বের প্রায় ১১৬টি দেশে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) 'বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা' বা পিএইচইআইসি ঘোষণা করেছে।
পিএইচইআইসি অবস্থা হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ স্তরের সতর্কতা। কোনো একটি রোগকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গবেষণা, তহবিল ও বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য পদক্ষেপে গতি আনার জন্য এ সতর্কতা জারি করা হয়।
বাংলাদেশে এমপক্সে আক্রান্ত কোনো রোগী এখনো শনাক্ত হয়নি। তবে আমাদের পার্শ্ববতী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার দেশগুলোতে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর উপস্থিতি এবং মৃত্যু আমাদের উদ্বেগের কারণ।
এমপক্স ভাইরাস সম্পর্কে সবাইকে জানানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে সার্বিক প্রস্তুতি এবং পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করা জরুরি। আর এসব কারণেই বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা জারি করেছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থা।
মাংকি পক্স একটি ভাইরাসজনিত (জুনোটিক) রোগ। এমপক্স রোগের জন্য দায়ী মাংকি পক্স ভাইরাস স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত ভাইরাস গোত্রের, তবে এখনো কম ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচ্য। এমপক্স ভাইরাস প্রথমে পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল, কিন্তু এখন মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ হচ্ছে।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে গত জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় এক লাখ এমপক্স আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অন্তত ২০৮ জন মারা গেছেন।
অন্যদিকে এ বছরের শুরু থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এমপক্সে সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে এবং মারা গেছেন অন্তত ৪৫০ জন। তাই দেশজুড়ে সচেতনতা তৈরি এবং এমপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করাও জরুরি।
এমপক্স ভাইরাস উদ্ভব হয়েছে বানর থেকে ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালিসহ এ জাতীয় বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে। আগে বন্যপ্রাণী শিকারের সঙ্গে জড়িত মানুষ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতেন। কিন্তু বর্তমানে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে এমপক্স ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে। এজন্য ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
গবেষকদের মতে, এমপক্স ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি যেকোনো ধরনের সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যৌনমিলন ছাড়াও শ্বাসনালি, ক্ষতস্থান, নাক, মুখ কিংবা চোখের মাধ্যমেও এ ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে সুস্থ ব্যক্তির দেহে। আবার আক্রান্তের ব্যবহার করা পোশাক-পরিচ্ছদ থেকেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তাছাড়া রোগীর ব্যবহৃত সুই বা অন্যান্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে, আক্রান্ত পশু বা প্রাণী শিকার করা, কাটা বা রান্না করার সময়, কম তাপমাত্রায় রান্না করা মাংস খেলে এমনকি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের থেকে তার অনাগত সন্তানও এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এমপক্স শুকিয়ে যাওয়ার পর ফোসকার আবরণ থেকেও ভাইরাস সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে মানুষের মধ্যে এমপক্সের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। এর লক্ষণও নানাবিধ। এমপক্স রোগের সাধারণ উপসর্গগুলো হচ্ছে জ্বর এবং সঙ্গে তীব্র শরীর ও মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জায়গার লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা। তাছাড়া সাধারণত জ্বরের তিনদিনের মধ্যে শরীরের নানা জায়গায় পানি ভর্তি ফুসকুড়ি বা ফোসকা হয় এবং সেখানে চুলকানি ও ব্যথা হয়, যা মুখ থেকে পর্যায়ক্রমে পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এগুলো সাধারণত ২–৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি সেরে যায়। তবে এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীনও থাকতে পারেন। নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এ রোগের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকেন। তাই তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া অনেক জরুরি।
সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা এমপক্সে আক্রান্ত দেশ/লোকালয় থেকে ফিরে আসার ২১ দিনের মধ্যে জ্বর হলে এবং ফুসকুড়ি দেখা দিলে এ ভাইরাসে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। এমপক্স আক্রান্ত হলে সবাইকে তা জানাতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন ১০৬৫৫ বা জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরেও যোগাযোগ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে।
এ রোগের উপসর্গগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে উপশম হয়ে যায় বলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কিছু যত্ন ঘরোয়াভাবেই নেয়া যাবে। রোগীকে আইসোলেশনে রেখে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে। যেমন, জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, ফুসকুড়ি বা ক্ষতস্থানের যত্ন নেওয়া, পরিস্কার-পরিছন্ন জায়গায় রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পূর্ণ বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে এবং রোগীর সংস্পর্শে এলে অবশ্যই গ্লাভস ও মাস্ক পরতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিয়ে রোগীর চিকিৎসা ও সেবা দিতে হবে। পাশাপাশি এমপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, নিয়মিত সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা রাখা প্রয়োজন।
এমপক্স উদ্বেগের কারণ মূলত আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে সংক্রমণের হার কেমন তার ওপর নির্ভর করছে। এখনই দেশের প্রবেশপথগুলোতে স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। যাদের মধ্যে লক্ষণ দেখা যাবে তাদের পরীক্ষা করাতে হবে। বিশেষ করে এমপক্স আক্রান্ত দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর আলাদা নজর রাখতে হবে। এমপক্স রোগী শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পনায় রেখে সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের এগিয়ে আসা উচিত কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য। প্রয়োজনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী একটি জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা যায়। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই কেবল এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব।
ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ: সিনিয়র জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং চেয়ারম্যান, গ্যাভি সিএসও স্টিয়ারিং কমিটি