শরীরে ২০০ ছররা গুলির আঘাত, দৃষ্টি নেই একচোখে: পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় দিনমজুর হাবিব
শরীরে ২০০ এর বেশি ছররা গুলি, একটি গুলি ডান চোখে বিদ্ধ হওয়ায় এখন সেই চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না মোহম্মদ হাবিব খাঁন। এই অবস্থায়ও তাকে চিন্তা করতে হচ্ছে কীভাবে ৪ সদস্যর সংসারের খরচ চলবে।
১৯ জুলাই (শুক্রবার) স্যানিটারি মিস্ত্রী মোহম্মদ হাবিব কাজের পারিশ্রমিক আনতে যাওয়ার পথে রাজধানীর মোহম্মদপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন সারাদেশের মতো মোহম্মদপুরেও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি চলছিল।
২০ আগস্ট মোহম্মদ হাবিবের (৩০) সঙ্গে কথা হয় দ্য বুজনেস স্ট্যান্ডার্ডের। তিনি বলেন, "আগে কাজ করেছিলাম সেই পাওনা টাকা আনতে ১৯ তারিখ বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মোহম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এর ১ নম্বর রোডে গিয়েছিলাম। সঙ্গে আরও ২ জন শ্রমিক ছিলেন। ওই সময়ে এলাকায় পুলিশ ব্যাপক গুলি ছোঁড়ে, সংঘর্ষ চলছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।"
হাবিব বলেন, "পুলিশ আমাদের দিকে ছররা গুলি মারার সময় সাথে থাকা অন্য শ্রমিকরা দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমি হাত জাগিয়ে বলছিলাম আন্দোলনে আসিনি আমাকে গুলি করিয়েন না। তবুও আমার গায়ে গুলি করে পুলিশ।"
গুলিতে আহত হওয়ার পর হাবিবের সঙ্গে থাকা অন্য শ্রমিকরা তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। এরপর সেখানে টানা ৬ দিন ছিলেন তিনি।
হাবিব বলেন, "শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তেমন ভালো চিকিৎসা পাইনি। ভর্তি হওয়ার ৬ দিন পর বাম চোখে গুলি লাগায় অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে আমাকে আগারগাঁও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপতালে পাঠানো হয়। সেখানে আমার ডান চোখে অপারেশন হয়, কিন্তু তার পরেও চোখে দেখতে পারছি না।"
মোহম্মদ হাবিব বলেন, "চক্ষু বিজ্ঞান হাসপতালে ৪ দিন ছিলাম। কিন্তু মনে হয়েছে এখানেও আমার চিকিৎসা ভালো হচ্ছে না। তাই হাসপাতাল থেকে চলে আসি।"
হাবিবের হাসপাতালের এক্সরে রিপোর্টে তার শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির দাগ দেখা যায়।
হাবিব বললেন, "ডাক্তার বলেছেন- এখন প্রায় ২০০ গুলি (ছররা) আছে শরীরে। মাথার ৪-৫টি গুলি বের করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন- শরীরে যে গুলি আছে, এগুলো বের করতে হলে সারা শরীর কাটাকাটি হবে, এর চেয়ে ভালো গুলি শরীরে থাকুক। ৬ মাসের মতো ব্যথা থাকবে।"
সরকারি হাসপাতালে চোখের ভালো চিকিৎসা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার দেখান হাবিব।
তিনি জানান , টাকা ধার করে হারুন আই হসপিটাল-সহ মোহম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিসৎসা নিয়েছেন। সব মিলে গত ১ মাসে তার প্রায় ৬৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ডান চোখে কৃত্রিম লেন্স লাগালে চোখে দেখা যেতে পারে। তবে সেখানে খরচ হবে প্রায় এক লাখ টাকা। টাকার অভাবে এখন চিকিৎসা করাতে পারছেন না হাবিব।
বরগুনা কাঠালতলী উপজেলায় হাবিবের বাড়ি। প্রায় ১২ বছর ধরে ভাড়া বাসায় থাকেন মোহম্মদপুরে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মাদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ২ নম্বর সড়কের পাশে ফাঁকা জায়গায় একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকেন তিনি।
বাসা ভাড়া প্রতিমাসে ৪,৫০০ টাকা। ১২ বছর বয়সী হাবিবের মেয়ে মোহম্মদপুরের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ের প্রাইভেট শিক্ষকের বেতনসহ সব মিলে প্রতিমাসে খরচ হয় ২,০০০ টাকা। ছেলের বয়স ৪ বছর, এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। পুরো পরিবার হাবিবের আয়ে চলে। এখন কীভাবে এ খরচ চলবে সেই চিন্তা করছেন হাবিব।
হাবিব বলেন, "স্যানিটারি মিস্ত্রীর কাজ করলে প্রতিদিন ৭০০ টাকা আয় হতো। কখনও ময়লার কাজ করলে ৯০০ টাকা পেতাম। এখনতো এক চোখে দেখি না, কাজ করার মতো অবস্থায় নেই। আজকেও সংসারের খাবার খরচের জন্য ২০০ টাকা এক জনের কাছ থেকে ধার এনেছি।
তিনি বলেন, "আমার ছেলেটা বলেছে, 'বাবা মানুষে আগের মতো ভালো পায় না'। এ কথা শুনে আমরা খারাপ গেলেছে। তখন বলেছি, 'বাবা আমার কাছে ১০০ টাকা আছে, তোমরা দুই ভাইবোন এই টাকা দিয়ে কিছু খাও'। ৫০ টাকা নিয়েছে ছেলেটা, বাকি ৫০ টাকা আমাকে দিয়ে বলেছে, 'তুমি এই টাকা দিয়ে কিছু খেও'। এরপর আমি অনেক কান্না করেছি।"
হাবিব বলেন, "জানিনা কি হবে আমার । কীভাবে চলবে সংসারের খরচ। আজকেও বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়ার জন্য লোক পাঠিয়েছিল, ভাড়া দিতে পারিনি। এই অবস্থায় চাওয়া সরকার যেন আমার সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। আমি কাজ না করতে পারলে, পরিবার না খেয়ে মরবে।"