‘ছেলেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখা যে কী কষ্টের, বলে বোঝাতে পারব না’
ঘুম থেকে জাগার পর রাকীন কি আবার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে পারবে? বলার সময় আসেনি এখনো। ষোলদিন (২১ আগস্ট পর্যন্ত) ধরে ঘুমাচ্ছে শাহরিয়ার রাকীন। ঘটনাটা ঘটেছিল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর রটতে না রটতেই।
পঞ্চগড় সদরে রাকীনদের বাড়ি; দশম শ্রেণিতে পড়ে আহমদ নগর হাই স্কুলে। তারা চার ভাই বোন। বোন তাইয়্যেবা সবার ছোট। রাকীন তাইয়্যেবার চেয়ে বড়। বাবার নাম মো. আব্দুল ওয়াহাব। তার ৭০ শতক জলাশয় আছে, সেখানে তেলাপিয়া মাছ চাষ করেন, তা দিয়ে পঞ্চগড়ে তাদের দিন চলে যায়। ঘটনা ঘটার ১০ মিনিট আগেও রাকীন বাড়িতেই ছিল।
শেখ হাসিনার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরবাসী ও শহরতলীর অনেক লোক রাস্তায় নেমে এসেছিল রড, লাঠি, ছুরি হাতে। ত্রিমুখী বা চতুর্মুখী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল। মারামারির সময় কারো হুশ ছিল না। রাকীনের মাথায় সজোরে লাঠি দিয়ে কেউ আঘাত করে থাকবে। তাতে ব্রেন হেমারেজ হয় বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। আর রাকীন চেতনা হারায়, শুধু তার শরীরের বাঁ দিকটায় সাড়া দিচ্ছিল। কিছু সময় পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নেয়, রাকীনকে পৌঁছে দেয় হাসপাতালে।
আব্দুল ওয়াহাব বাড়িতেই ছিলেন। পড়শিদের একজন দৌড়ে এসে খবর দিয়ে যান, আপনার ছেলে হাসপাতালে। ওয়াহাব দিশা হারিয়ে ছুটে যান, সঙ্গে তার দুই ছেলে, পিছু পিছু বড় ভাই ও এক ফুপাতো ভাই। বাইরে থেকে পিঠে কিছু আঘাতের দাগ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, তবে রাকীন নিঃসাড়। দেখে হাউমাউ কেঁদে ওঠেন আব্দুল ওয়াহাব। কিন্তু এখন তো কান্নার সময় নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, "এই রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সরঞ্জাম আমাদের এখানে নেই। রংপুর সদর হাসপাতালে নিতে হবে।"
ওয়াহাব ও অন্যরা যে যেদিকে পারলেন ছুটলেন অ্যাম্বুলেন্স জোগাড়ের আশায়। কিন্তু পথে পথে তখনো খণ্ড যুদ্ধ হয়ে চলেছে। রিকশা, ভ্যানেরও দেখা মিলছে না। শেষে একজনকে বলেকয়ে রাজি করানো গেল, ভাড়া চাইল ছয় হাজার টাকা। ওয়াহাবের তখন দরাদরি করার মতো মন ছিল না, সময়ও ছিল না । রওনা হলেন রংপুর। পথে পথে দু'চার জায়গায় গাড়ি থামানো হলো। রোগীর অবস্থা দেখে মায়া জাগল অবরোধকারীদের মনে। তারা পথ করে দিল, অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে চললো। রাকীনের মা কেঁদেই চলেছেন, সঙ্গে ছোট বোনটিও। রাকীনের দশা দেখে কারো মনে আশা জাগছে না, তবু সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে পথ চলছেন।
রংপুর হাসপাতালে পৌঁছে জানলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কেউ নেই, সবাই নাকি ঢাকায়! ইমার্জেন্সি ডাক্তার হাত লাগানোর সাহসও করছেন না। এমন অবস্থায় রাতটা কাটলে একজন পরামর্শ দিলেন, কাছে প্রাইম নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল আছে, সেখানে ডাক্তার পাওয়া যেতে পারে। প্রাইমে গিয়ে একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। তিনি সোজাসুজি বললেন, "আমরা চিকিৎসা চালাতে পারি, তবে সবচেয়ে উত্তম হলো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া। সেখানে কোনো না কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ মিলে যাবে।"
চৌদ্দ হাজার টাকায় আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা রওনা হলেন আব্দুল ওয়াহাব ও তার পরিবার। দীর্ঘ সে ক্লান্তিকর, বিষণ্ন যাত্রা। মাঝে মধ্যে রাকীনের মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলে কেবল নীরবতা ভঙ্গ হয়। মা যখন কান্না করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন তাইয়্যেবা তখন বলে— 'ভাই, ও ভাই কথা বলো। ভাইগো আমি আর তোমার কলম ধরব না, কথা বলো।'
শেষে রাত আড়াইটায় ওয়াহাবের পরিবার আগারগাঁওয়ে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। রাকীনকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়। পরের দিন সকাল ৮টায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে সহকারীদের অপারেশন থিয়েটার রেডি করতে বলেন । সকাল ১০টায় রাকীনকে ওটিতে ঢোকানো হয়, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন চলে। পরে তাকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বিশেষ অনুমতি ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। টানা ১২ দিন রাকীন পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ছিল।
ঘটনার দিন ওয়াহাবের বড় ভাই কথায় কথায় বলেছিলেন, এমন রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ১ ভাগ। ওয়াহাব বলেছিলেন, এক ভাগের ওপরই চিকিৎসা করাব। ওয়াহাব শুনেছেন চার-পাঁচদিন হয়ে গেলেই নাকি এমন রোগীর ভালো-মন্দ স্থির হয়ে যায়। এখন ষোলদিন হতে চলেছে রাকীনের অবস্থা আর অধিক খারাপ হয়নি, বরং ঘোরের মধ্যেই অস্ফুটে দু চারটি কথা বলছে মাঝেমধ্যে। ডাক্তার বলেছিলেন, যদি ঘটনার দিনই অপারেশন হতো, তবে আরো ভালো ফল আশা করা যেত।
দুই দিন হলো রাকীনকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড থেকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। সারাক্ষণই কাউকে না কাউকে কাছে থাকতে হচ্ছে। ছয়জনের পরিবারটির সবাই এখন ঢাকায় তথা হাসপাতালে। বাড়ি তালাবদ্ধ করে রেখে এসেছেন। শঙ্কা এখনো আছে, মাঝে মধ্যে ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসছে রাকীনের। ডাক্তার বলেছেন, রাকীনকে উচু মাত্রার পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। এর মধ্যে সুখের ব্যাপার হলো, এখন থেকে রাকীনের চিকিৎসা খরচ আর লাগছে না , বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহতদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ওয়াহাব বললেন, "ডাক্তার বলেছেন রাকীনের নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। ছেলেটি দারুণ দুরন্ত ছিল। খেতে খুব ভালোবাসতো। নিজে নুডলস বানিয়ে খেতো, ডিম ভেজে নিতো, বাদাম ভাজতে পারতো ভালো। সাইকেল চালাতো, ক্রিকেট খেলতো, ফুটবলে স্ট্রাইকার হতো। ছেলেটিকে শুয়ে থাকতে দেখে আর সইতে পারছি না। হাসপাতালে ছেলেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখা যে কী কষ্টের ভাই, বোঝাতে পারব না।"
আব্দুল ওয়াহাবের চোখ ভিজে উঠল। কথা বলতে পারছেন না আর। শুধু বললেন, "দোয়া করবেন ভাই, আর কিছু চাই না।"