১৮ কোটি মানুষের ৯০ কোটি দাবি
১৯৭২ সালে হলিডে ম্যাগাজিনের সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান হতাশা থেকে 'সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস' অর্থাৎ '৬ কোটি ৫০ লাখ সহযোগী' শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন।
তার বায়ান্ন বছর পর ২০২৪ সালে এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি ৯০ কোটি।
সংখ্যাটা অবলীলায় ১০০ কোটি করা যেত। এতে সমস্যা দুটি। এক. জনপ্রতি দাবির সংখ্যায় দশমিক বসাতে হতো। কিন্তু দাবির সংখ্যায় তো আর দশমিক হতে পারে না। তাই জনপ্রতি পাঁচটি করে ৯০ কোটি।
দুই নম্বর সমস্যা হলো দাবির সংখ্যা ৯০ কোটির বেশি হলে, ধরা যাক ১০৮ কোটি। তাহলে জনপ্রতি দাবি পাঁচের বেশি হয়ে যায়। সেটাও খুব ভালো দেখায় না। মানুষের দাবি আছে। কিন্তু তারও একটা সীমারেখা থাকা উচিত। তাই মাথাপিছু পাঁচ এবং মোট ৯০ কোটিই সই। এতে সবার দাবিই আশা করছি মিটে যাবে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সবাই যেভাবে এক এক করে দাবি নিয়ে আসছে, আশা করা যাচ্ছে এ হিসাবে সবার দাবিই পূরণ করা যাবে।
যদি বয়সে ছোট এমন কারো দাবি থেকে শুরু করি তাহলে ধন্যর কথা বলতে হয়। ধন্য সাংবাদিক মেহেদী মাসুদের আড়াই বছরের ছেলে। মাসুদ ফেসবুকে লিখেছেন, "হায় হায়, 'দাবি'র হাওয়া দেখছি বাসার ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। এখন এই পুঁচকেও দাবি জানাচ্ছে। কী দাবি? আমাদের ছোট ছেলে ধন্যর দাবি, ও কিছুই খাবে না। খাবার দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।"
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক কাজী আনিসও ফেসবুকে কিছু দাবির কথা লিখেছেন।
তার দাবি, "একটানা বৃষ্টির প্রতিবাদে, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। আবহাওয়া অফিস ঘেরাও করতে হবে। শাহবাগে আমাদের সাথে যোগ দিন, তবে ছাতা আনতে ভুলবেন না..."
কাজী আনিস তার নিজের ছাড়াও আরও বিভিন্ন দাবির কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, "জামদানি শাড়ির দাম কমানোর দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও। আকিজ বিড়িতে চুরুট বাড়ানোর দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভ। এক চাচা বললেন, 'এই বিড়ি আমাকে কাশি দেয়। আমি মানিনা। মিডটার্ম, প্রেজেন্টেশন এবং অ্যাসাইনমেন্ট বাতিলের দাবিতে হলের জানালায় ইট ছোড়া কর্মসূচি। কিশোরদের তিনদিনের মধ্যে দাড়ি গজানোর দাবিতে নাপিতের বাড়ি ঘেরাওসহ মানুষের আরো অনেক দাবি..."
নতুন সরকার গঠনের পর থেকে দাবির মিছিল শুরু হয়েছে। আঠারো কোটি মানুষের সবার কোনো না কোনো দাবি আছে। সেই দাবি মেটানোর এখনই সময়।
কারো দাবি কর্তৃপক্ষের পদত্যাগ। কেউ কেউ ডাক্তার পরিচয়ের জন্য মেডিক্যাল লাইসেন্স চাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ চাচ্ছেন নতুন পারমিট। রিকশাচালকরা মোটরচালিত রিকশার ওপর নিষেধাজ্ঞা চান, মোটরচালিত রিকশাচালকরা চান উল্টো। কেউ কেউ তাদের চাকরি নিয়মিত করতে চান। সর্বশেষটি দাবি ছিল আনসারদের। আবার কেউ কেউ তাদের বকেয়া দাবি-দাওয়ার দাবিও জানিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষ যেই হোক, দাবি যার কাছেই হোক, কাজ একটাই রাজপথ বন্ধ করে দিতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা।
পরীক্ষা দেব না, নামো রাস্তায়। ঘেরাও করো সচিবালয়। সবকিছু অটো চাই। প্রেমটাও অটো হোক। প্রয়োজনে বিয়েটাও। সন্তান অটো চায় কিনা সেটা পরিষ্কার না। তবে অটো বিসিএস, অটো চাকরির দাবি জানানোই যায়। চাকরি হলে কাজ না করে অটো বেতনের দাবিও জানান অনেকে।
খালি আওয়াজ তোলো। দাবি জানাও।
দাবি, এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে চাকরি স্থানান্তর করা যাবে না। এর জন্য ধর্মঘট। অন্যকে এনআইডি দেওয়ার আগে নিজেরটা ঠিক করে নিতে হবে। তাই না?
অন্য কেউ আমার থেকে বেশি আয় করে, আর আমি কম আয় করি; মেট্রোরেল বন্ধ করুন। আমার বাড়ি থেকে মেট্রো না চললে কেউ যেন মেট্রো পরিষেবা না পায়। ধর্মঘটে যান।
"আপা" এবং "ভাইয়া," আপনি গ্রামের হোন বা শহুরে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনারা আওয়াজ তুলুন। আপনার দাবি জানান!
এসব দাবিদারদের কাছে মানুষ এখন অসহায়। তারা রাস্তা অবরোধ করছে। সাধারণ মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছে কিংবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকছে।
আমরা সৌভাগ্যবান যে অপেক্ষা করার সময়, যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা তাদের সহনশীলতা অতিক্রম করছেন না এবং রাস্তায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন না। অথবা, জয়েন্টের ব্যথা বা হাঁটুর ব্যথা অন্যান্য ব্যথা নিরাময়ের দাবিতে রাস্তায় নামছেন না।
অথবা কারো পলক (পলক) বা অন্য কারো দুই নম্বর (বিপু) ফেরত দেওয়ার দাবিও জানাচ্ছেন না।
একটি ফেসবুক পোস্টে একজন লিখেছেন, "বাচ্চাদের স্কুলে নামানোর পর কয়েকজন মা কথা বলছিলেন, 'সবাই দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। চল আমরাও নামি।' তখন একজন জিজ্ঞেস করলেন, 'আমাদের দাবি কী?' আরেকজন বলল, 'পাশে একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে, চলেন সেখানে বসে কী দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারি সে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।"
যিনি এটা লিখেছেন তার নামটা আমি স্মরণ করতে পারছি না। এজন্য দুঃখিত। তবে ভয়ে আছি, তিনি না তার নাম উল্লেখের দাবি জানান। সেটা অবশ্য খুব বেশি সমস্যার না। কারণ এমন দাবি উঠলে নাম যোগ করে দেওয়া যাবে। রাস্তায় অন্তত নামতে হবে না।
এমন দাবি দাওয়া নিয়ে কিন্তু কবিরাও লিখেছেন।
কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার। আমাদের অবস্থা হয়েছে যৌবন থাকুক বা না থাকুক, রাস্তায় নামার এখনই সেরা সময়।
আমরা এখন সেই গরুর পাল যাদের রাখাল বালক হারিয়ে গেছে। মিথ্যা মিথ্যা বাঘ আসলো, বাঘ আসলো বলতে বলতে সত্যি সত্যিই একদিন বাঘ এসে তাকে নিয়ে গেছে। আমরা এখন হাম্বা-হাম্বা করে কাঁদছি। আমাদের কান্না পানি হয়ে বন্যায় ভাসিয়ে নিচ্ছে মানুষকে। কিন্তু, দাবির মিছিল থামছে না।
এদের কে থামাবে? পুলিশ?
তারাই নিজেদের দাবি আদায়ের মাধ্যমে এটা শুরু করেছে। শত শত মানুষকে হত্যার পর তারা এখন নৈতিকভাবে দুর্বল। অনেকে নিজেরাই পলাতক। যারা ডিউটিতে আছেন তাদের সাহস নেই কাজ করার। তারা কীভাবেই বা পারবে? তারা আগে যা করেছে তা দেখে তারা এখন তাদের আসল দায়িত্ব পালনে ভয় পাচ্ছে।
তাদের সহায়তা করতে পারত শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজনে দাবিওয়ালাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘরে ফেরাতে পারত। অনেকের প্রশ্ন: তারা কোথায়? তারা কেন আর রাস্তায় নেই?
তারা রাস্তায় থাকবে কীভাবে! আপনি-আমিই তো গলা উঁচু করে দাবি জানিয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়েছি। মানে সেখানেও একটা দাবির বিষয় ছিল। গণদাবি।
মানুষের এতো এতো দাবির মধ্যে সাংবাদিকরা পড়েছেন পারিবারিক দাবিতে। পরিবার থেকে দাবি উঠেছে, সাংবাদিকদের অফিস টাইমও সরকারি অফিসের মতো ৯টা-৫টা করতে হবে। সন্ধ্যায় আউটিং চাই।
এক সাংবাদিক বললেন, তার স্ত্রী হুমকি দিয়েছেন পারিবারিকভাবে দাবি না মানলে অন্যদের নিয়ে রাজপথে নামবেন। রাস্তায় নেমে রাস্তা বন্ধ করেই তাদের দাবি তুলে ধরবেন।
এখন ৯০ কোটির সঙ্গে এ দাবিটাও যোগ করলে সংখ্যা ঠিক রাখতে কোনো একটা দাবি ছেঁটে ফেলতে হবে। তো কোন দাবি ছেঁটে ফেলবো? তাই সেই দাবিও রেখে গেলাম।
তবে সবকিছুর আগে আমাদের অবশ্যই রাস্তায় নামতে হবে এবং দাবি নিয়ে রাস্তা অবরোধ করতে হবে। যারা আমাদের রাস্তা অবরোধ করছে তাদের রাস্তা থেকে সরাতে হবে।
এটাই আমার চাওয়া।