শেখ হাসিনার আমলে দেশের ঋণ বেড়েছে ১৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ঋণ বুলেটিনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ ১৪ লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা বেড়েছে।
বুধবার (২৮ আগস্ট) প্রকাশিত ওই বুলেটিন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা।
এপ্রিল থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঋণের অবস্থা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। অর্থ কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, এ সময়ে সরকার ব্যাংকগুলো থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।
ওয়েস অ্যান্ড মিনস অ্যান্ড ওভারড্রাফ্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা থাকলেও জুন ও জুলাইয়ে প্রতি মাসে ২৪ হাজার কোটি টাকা করে মোট ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এটি।
এ দুমাসের জন্য অতিরিক্ত ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রাথমিকভাবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছ থেকে মৌখিক অনুমোদন নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পরে বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে পূর্ববর্তী অনুমোদন পেয়েছে।
কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, রাজস্ব আদায় কম থাকায় সরকার দায় পরিশোধের জন্য জুন মাসে এবং অভ্যুত্থানের কারণে জুলাই মাসে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছিল। তাই শেখ হাসিনার পদত্যাগের সময় পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারের ব্যাংক ঋণ ২০২২ সাল থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প দ্রুত শেষ করতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল।
একইসঙ্গে, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছিল। তবে এ ব্যয় মূলত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর পরিবর্তে দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মোট ঋণের মধ্যে উচ্চ সুদের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ নয় লাখ ৮২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। আর স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সাত লাখ ১৪ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হার বিদেশি ঋণের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুদব্যয়ও বাড়ে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধের লক্ষ্যে দেশীয় ঋণের জন্য ৯৬ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের জন্য ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মিলিয়ে মোট এক লাখ ১২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি ঋণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুবছর নয় মাসের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ প্রায় ১৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে সরকার তিন লাখ ৩৪ হাজার ২৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, যা ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ নাগাদ বেড়ে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা হয়।
এছাড়া ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ধার করা প্রায় তিনগুণ বেড়েছিল। ট্রেজারি বন্ড ও বিশেষ বন্ড থেকে ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ে। আর সুকুকের (শরিয়াহ-সম্মত বন্ড) এর মাধ্যমে ধার নেওয়ার হার বাড়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
তবে সঞ্চয়পত্র বন্ড থেকে ঋণ গ্রহণ অপরিবর্তিত ছিল।
৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারি ঋণের মধ্যে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে এক লাখ ৩২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, ট্রেজারি বন্ড ও বিশেষ বন্ড থেকে চার লাখ ১০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, সুকুক থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে তিন লাখ ৫২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা এবং জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ অন্যান্য উৎস থেকে ৬৮ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা নেওয়া হয়।
সার এবং বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকির ব্যয় মেটাতে সরকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড জারি করে।
অর্থ বিভাগ অনুসারে, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকার স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) ভর্তুকির জন্য বন্ডে ১০ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা এবং সার আমদানির জন্য নয় হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা ইস্যু করেছে।
এসব বন্ড আইপিপি এবং সার আমদানিকারকদের ঋণের বিপরীতে পাওনাদার ব্যাংকগুলোকে ইস্যু করা হয়েছিল। এসব ব্যাংক রেপো হারে সুদ পেয়েছিল যা বর্তমানে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে সরকারের ঋণ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, সরকার এ ধরনের বন্ড ইস্যু করে ভর্তুকি দায়বদ্ধতা পূরণ করতে পারে না।
'বর্তমান ঋণ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, 'গত ১৫ বছরে অর্থনীতির প্রসার ঘটেছে, বাজেট বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। ফলে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি স্বাভাবিক।'
তবে ধার করা তহবিল টেকসই কি না এবং দেশের ঋণ পরিশোধের আর্থিক সক্ষমতা আছে কি না তা মূল্যায়ন করা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
'কোনো দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতার একটি প্রধান সূচক হলো এটির কর রাজস্ব আহরণ এবং দেশটির পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে কি না। কারণ বৈদেশিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়,' তিনি বলেন।
তৌফিকুল বলেন, বর্তমান ঋণ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে জিডিপির প্রকৃত আকারকে ঘিরে অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বাংলাদেশের জন্য ঋণ পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করা যায়, এটি ঋণ পরিস্থিতির একটি পরিষ্কার চিত্র প্রকাশ করবে।