তারা কি আর কখনো ফিরে আসবেন? হার মানতে নারাজ নিখোঁজদের স্বজনেরা
স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ইসমাইল হোসেন। এছাড়া ২০১৯ সালের ১৯ জুন অপহরণের আগ পর্যন্ত তিনি তার ২২ সদস্যের বৃহৎ পরিবারের; দুজন বিধবা বোন ও তাদের আট সন্তান, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভাই ও তার পরিবার এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের অভিভাবক এবং অর্থদাতা ছিলেন।
ইসমাইলের স্ত্রী নাসরিন জাহান স্মৃতির সন্দেহ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) এক কর্মকর্তা তাকে অপহরণ করেছেন।
তসলিমা নাসরিন বলেন, 'আমার স্বামী বিএনপি নেতা ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির জন্য নয়, ওই কর্মকর্তা পূর্ব শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তাকে অপহরণ করেন।'
তিনি বলেন, 'তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা সবাই অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার স্বামীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করা যায়নি। আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে প্রতিটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা কোনো টাকা দিতে চায়নি, কারণ আমি ডেথ সার্টিফিকেট দিতে করতে পারিনি।'
নাসরিন একসময় ব্যবসায়ী স্বামীর আয় এবং শিক্ষক হিসেবে নিজের আয় দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করতেন। তবে স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি ও তার পরিবার শুধু অর্থনৈতিক কষ্ট ও মানসিক আঘাতই পাননি, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা তার মেয়েকে অনুসরণ করাসহ নিয়মিত বিভিন্ন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
স্বামীর সন্ধানে নিরলস খোঁজাখুঁজির পরও এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
নাসরিন মনে করেন, গুমের ঘটনায় র ্যাবের সম্পৃক্ততার কারণেই তার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের জীবন এখন দুঃখে ভরা। আমার মেয়ে আগে গাড়িতে করে স্কুলে যেত, কিন্তু এখন সে হেঁটে কলেজে যায়। আমি তাকে যাতায়াতের জন্য কিছু টাকা দিই এবং সে বাকি পথটুকু হেঁটে যায়।'
নাসরিন বলেন, 'অনেক সময় আমার কাছে ২ টাকাও থাকে না। ওই মুহূর্তগুলোতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কেন আমাদের এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে, যেখানে আমরা কোনো ভুলই করিনি। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।'
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের গত ১৫ বছরে ইসমাইলের মতো শত শত মানুষ গুমের শিকার হন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লু) এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬০০টিরও বেশি গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে কয়েকজনকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়, আদালতে হাজির করা হয় অথবা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের তৈরি সংগঠন 'মায়ের ডাক' বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তারা নিখোঁজ ১৫৮ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) কাছে পাঠায়।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে গুমের শিকার মাত্র তিনজন জীবিত ফিরে এসেছেন: মাইকেল চাকমা, মীর আহমাদ বিন কাসেম এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী।
তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সে (আইসিপিপিইডি) যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
এই কমিশন ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত ও তারা কোথায় আছেন তা খুঁজে করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
'মায়ের ডাক'-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলী স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, প্রতিবেদনে যেন কোনো তথ্য গোপন না করা হয়।
তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রমাণ জমা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি ব্যবস্থারও আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মায়ের ডাক-এর কর্মী নুসরাত জাহান লাবনী বলেন, 'কী ঘটেছে আমরা তার একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ চিত্র চাই।'
কমিশন গঠন করায় খুশি নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা সম্রাট মোল্লার বোন কানিজ ফাতেমা।
তিনি বলেন, 'আমরা কমিশনের কাছে বেশি কিছু চাই না। আমরা শুধু জানতে চাই তারা বেঁচে আছেন কিনা। আমরা আশা করি আমাদের প্রিয়জনরা এখনও বেঁচে আছেন, তবে তারা যদি বেঁচে না থাকেন তবে আমরা কমিশনের কাছে বিচার চাই।'
সম্রাট ছিলেন তার পরিবারের প্রধান অভিভাবক। তিনি তাদের দোকান পরিচালনা করতেন এবং তার বৃদ্ধ বাবা ও ভাইবোনদের ভরণপোষণ করতেন।
সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সম্রাট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর কারাগারে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সময় সম্রাটসহ চারজনকে আটক করে ডিবি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যেতে দেখেছেন, কিন্তু আটকদের মধ্যে তিনজনকে পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও সম্রাট ও আরেক নেতা সোহেল নিখোঁজ রয়েছেন।
মামলা দায়েরের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সম্রাটের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে পরিবারটি পুলিশের সাহায্য পায়নি।
ফাতেমা বলেন, 'আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে বাংলাদেশে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করার সাহস না পায়। আমাদের পরিবারগুলো যে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছে তা বর্ণনার বাইরে; আমার মনে হয় মৃত্যু যন্ত্রণাও এত কঠিন নয়। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়রানির মুখোমুখি হয়েছি - সামাজিক, আর্থিক ও আইনি।
ফাতেমা আরও বলেন, 'আমার ভাই নিখোঁজ, এই নিয়ে বিভিন্ন কারণে সহজে বাসা ভাড়া পাওয়া যেতো না এবং আমার বোনদের বিয়ে দেওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তখন মানুষ জোরপূর্বক গুমের বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে পারত না। অনেকে ভেবেছিল আমার ভাই হয়তো সন্ত্রাসী ছিল বা কোনো অন্যায় করেছে।'
২০১৭ সালে ধানমন্ডি থেকে অপহৃত ইশরাক আহমেদের বাবা জামালউদ্দিনও কমিশনের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।
জামালউদ্দিন বলেন, 'আমরা আশাবাদী যে কমিশনের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাব।'
নাসরিন জাহান জানেন না তার স্বামী বেঁচে আছেন কিনা, তবে তার সন্তানরা তাদের বাবার জন্য অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, 'একদিন আমি ঘর পরিষ্কার করার সময় আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল কোনো কাগজপত্র ফেলে দিও না, বাবা ফিরে আসার পর সেগুলো খুঁজবেন। বাবার ফিরে আসার ব্যাপারে আমার মেয়ের এই আস্থা আমাকে আশাবাদী করে তোলে যে, কমিশন হয়তো তার বিশ্বাসকে সত্য করার কাজ করবে। আমি আশা করি তারা আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে অ্যাক্সেস ফিরে পেতেও সহযোগিতা করবে।'
নাসরিন বলেন, 'আমার সন্তানরা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে তাদের বাবা বেঁচে আছেন কিনা, আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। আপনাদের মাধ্যমে আমরা উত্তর খুঁজছি। যদি তিনি বেঁচে থাকেন তবে দয়া করে তাকে মুক্তি দিন; আর যদি তিনি না থাকেন, তাহলে কখন এবং কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে দয়া করে আমাদের জানান। আশা করি কমিশন আমাদের মতো আরও অনেক পরিবারের প্রশ্নের জবাব দেবে। আমাদের জানাবেন, যাতে আমরা অন্তত কুলখানি করতে পারি।'