জেন জি-এর ‘নাচুনে ডাকাত’
চুরি-চোর, ডাকাত-ডাকাতি শব্দগুলোর সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ঠিক কতদিনের তা হিসেব করতে বসলে মুশকিলে পড়তে হয়। তবে একেবারে কমদিনের যে নয়, তা যে কেউ হলফ করে বলতে পারবে। বাঙালিই বোধ হয় একমাত্র জাত যারা প্রণয়ঘটিত বর্ণনায় চুরি-ডাকাতির তকমা আঁটতে দুবার ভাবে না। ১৯৭৪ সালের জিঘাংসা চলচ্চিত্রে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে 'তুমি যে ডাকাত তুমি চোর, লুটে নিয়েছ হৃদয় মোর' গানে সে কথার প্রমাণ মেলে।
শুধু কি তা-ই? আমাদের ছোটবেলার অন্যতম মজার খেলা যে 'চোর-পুলিশ-ডাকাত' তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। 'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই', 'চোরের মায়ের বড় গলা', 'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি' থেকে 'দিনে দুপুরে ডাকাতি'র মতন প্রবাদ বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয় চুরি-ডাকাতি বাঙালির জীবনে কত সাধারণ ঘটনা।
রক্তচক্ষু ডাকাত যারা কি না গায়ে জবজবে সর্ষের তেল মেখে ডাকাতি করতে বের হতো — ডাকাতির সে জমানা এখন আর নেই। মুশকো জোয়ান দেহ, ইয়া বড় গোফও এখন আর ডাকাত হওয়ার যোগ্যতার কাতারে পড়ে না। রবিঠাকুরের যুগের মতন ডাকাতেরা আজকাল আর 'হারে রে-রে রে-রে' রব ছাড়ে না। কানে গোঁজে না জবাফুল। যুগের চাহিদায় একবিংশ শতাব্দীর ডাকাতেরা বদলেছে। তবে ডাকাত আর ডাকাতি কিন্তু হারায়নি। সে প্রমাণ মিলল গত ৫ আগস্ট থেকেই।
ছাত্র-জনতার ২০ দিনের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার লেজ গুটিয়ে পালায়। ১৬ বছর পর দেশের জনগণ যখন একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর কথা ভাবল, ঠিক তখনই এলে ডাকাত। যারা পুলিশের গুলির ভয়ে সরে দাঁড়ায়নি, করেনি প্রাণের ভয়, তারা কি আর ডাকাতকে ডরায়? বীরপুরুষের খোকার মতন বাংলাদেশের খোকারা বলে উঠল, "আমি বলি, 'দাঁড়া, খবরদার! এক পা কাছে আসিস যদি আর'-।" আর তাই দেশবাসীর ডাকাতের আশঙ্কা উৎসবে পরিণত হতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
তা যুগ বদলে ডাকাত যেমনি পালটেছে রূপ, তেমনি ডাকাত ধরার দলও ভোল পালটাবে এ আর আশ্চর্য কী? বাংলার দামাল ছেলে-মেয়েরা লাঠি হাতে নেমে পড়ল ডাকাত পাহারায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল ডাকাত ধরার দলের ছেলে-মেয়েদের কাণ্ডকারখানা।
দেশে আগস্টের ৫ তারিখের পর থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক ধরনের আইনশৃঙ্খলাজনিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সুতরাং ডাকাত ধরার দলের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলার হাল ধরতে নির্ঘুম রাত কাটান রাস্তায়। ছেলেদের বিভিন্ন ধরনের মুখোশ পরে হাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকার ছবি আতঙ্ক আর ভয় থেকে আমাদেরকে সরিয়ে নিচ্ছিল আস্তে আস্তে। চরম উৎকণ্ঠায় রাত কাটানো মানু্ষও এসব ছবি দেখে না হেসে পারেনি।
ধরা পড়া ডাকাতদের 'শাস্তি' হিসেবে বরাদ্দ ছিল জাতীয় সংগীত গাওয়া থেকে হিন্দি গানে নাচা। পরে অবশ্য এসব কীর্তিমান ডাকাতদের সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটি পোস্টে লেখেন, "ধরা পড়া ডাকাতকে দিয়ে গান গাওয়ানো সবচে' ভাল্লাগছে। দেখেন আপনারা যা মনে করেন।"
কথা হলো খুলনা জেলার একখানা ডাকাত ধরা দলের সঙ্গে। দলের সদস্য ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় সেমেস্টার-পড়ুয়া ডোনাল্ড অর্ণব। অর্ণবের ভাষ্যমতে, '৫ আগস্ট রাতেই খুলনা জেলায় আমার এলাকার আশপাশের কয়েকটা জায়গায় চুরি-ডাকাতির খবর আসতে শুরু করে। এমন খবর শুনে সেদিনই পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। প্রথম দিন এলাকাবাসীরা মিলে নিজ এলাকাতেই পাহারা দেওয়া হয়েছিল। পরদিন থেকে চুরি-ডাকাতি রোধে ছাত্রদের উদ্যোগে ডাকাত পাহারার দল তৈরি হয়।'
সে দলে ছিল ফাহিম, ধ্রুব, নাফিস, শুভ্র, অমিত, সাকিব, সালমান, আহানাফ, মাহিনসহ আরও অনেকে। 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আমাদের দলের কয়েকজনের নাম্বার খুলনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফোনকলের মাধ্যমে যেকোনো চুরি-ডাকাতির খবর পেলেই বাইক নিয়ে দলের সবাই ছুটে যেতাম।'
যেহেতু ঐ সময়ে কোনো কার্যকর প্রশাসন ছিল না, তাই ধরা পড়া ডাকাতের 'উপযুক্ত শাস্তি' নিশ্চিত করা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এ 'মুশকিলের' আসান হলেন ডাকাত পাহারাদারেরাই। আইন ভেঙে ডাকাতকে 'হাটুরে মার' কেউ দেননি বটে, কিন্তু ধৃত ডাকাতদের নিয়ে মজা লুটেছেন অনেকেই।
'আইন যেহেতু নিজের হাতে নেওয়া যায় না, আমরা ভাবলাম তাহলে ডাকাতদের দিয়ে একটু বিনোদন নেওয়া যাক। তাতে শাস্তিটাও ওদের বরাদ্দ হয়, আবার আমাদের পাহারাদলেরও মন কিছুটা উৎফুল্ল থাকে,' বলেন অর্ণব।
ধরা পড়া ডাকাতদের নাচতে বলতেন অর্ণব ও তার দল। 'অবাক ব্যাপার, ডাকাতেরাও বেশ এক্সাইটেড হয়ে নাচত! সে রাতে শাস্তি দেওয়ার পর পরদিন সকালে ডাকাতদের থেকে ডাকাতি ছাড়বার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ওদেরকে ছেড়ে দিতাম।'
এ ডাকাত পাহারাদলের ছেলেরা যে এ যুগের, তাই তাদের হাতে লাঠির পাশাপাশি ছিল 'Zello' নামক একটি ওয়াকিটকি অ্যাপ্লিকেশন। অর্ণবের মতে, সবচেয়ে মজার আর সহজ একটা যোগাযোগমাধ্যম এটি। 'যারা টহল টিমে ছিলাম সবাই এ অ্যাপে যোগাযোগ করেছি।'
ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে এক নতুন ধরনের ঐক্য দেখা দিতে শুরু করে। রাত জেগে ছেলে-মেয়েরা পাহারা দিচ্ছে। তাদের বাপেরাও মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে গল্পগুজবও শুরু হয়। এভাবেই ডাকাতের জুজু উবে যেতে শুরু করে সকলের তৎপরতায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, 'আমার বান্ধবীকে ডাকাতির ঘটনা বলছিলাম খুব আগ্রহভরে। আমি তখন ডাকাত নিয়ে বেশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। তারপর শুনলাম আমার বান্ধবীটি দা হাতে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ডাকাত পাহারা দিচ্ছে।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্পগুজব, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-উৎসবের পুরোনো সংস্কৃতিকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। সে সংস্কৃতি আবার কিছুদিনের জন্য ফিরেছিলে ডাকাতের 'কৃপায়'। ডাকাত পাহারার রাতগুলোয় জেলায় জেলায় ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন হয়েছে, আবাসন এলাকাগুলোতে পাত পেড়ে খেতে বসেছে ভোজনরসিক বাঙালি। এ বাড়ির ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে ও বাড়ির ছোট্ট মেয়েটার খেলাধুলোর সূত্রে দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছে। ছোট-ছোট চায়ের দোকানে চা-বিস্কুটের সঙ্গে জমেছে বয়স্কদের আনাগোনা। গান বেজেছে সাউন্ড বক্সে, কেউ কেউ খালি গলায় গান ধরেছে। সবখানেই একটা জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার। এমনকি ডাকাত আসা উপলক্ষে দোয়া মাহফিল পর্যন্ত হয়েছে।
এভাবেই ডাকাত আমাদেরকে কাছে টেনে আনল অনেকটা, আর আমরাও বুঝতে শুরু করলাম, ভয়কে কী করে জয় করা যায়। ডাকাত ধরার দলের পাশাপাশি ডাকাতকেও বোধহয় এ কারণে একখানা ধন্যবাদ দেওয়াই যায়।