সালমানের বিরুদ্ধে ৩৩,৪৭০ কোটি টাকা পাচার, নাফিজের তহবিল আত্মসাতের অভিযোগে সিআইডির তদন্ত
বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফত – শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি শাসনামলে ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু, এখন তারাই সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্তের অধীন।
বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার এবং আর্থিকখাতে অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাঁদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)-র এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা ছিলেন সালমান ফজলুল রহমান। গত ১৫ বছরে সাতটি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংক – যেখানে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, সেখান থেকে আরও ৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
দেশের পুঁজিবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা মুনাফা করা এবং ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন না করারও অভিযোগ আছে তার নামে।
সালমানের বেক্সিমকো গ্রুপের গ্রিন সুকুক ও আইএফআইসির গ্যারান্টিপ্রাপ্ত শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড নিয়ে তদন্তের জন্য গতকাল একটি কমিটিও গঠন করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা– বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
২০০৮ সাল থেকে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালনা করা নাফিজ সরাফত এবং তার সহযোগী হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধেও অর্থ পাচার, জালিয়াতি এবং তহবিলের অবৈধ অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থাটি বর্তমানে ১৩টি তহবিলের তত্ত্বাবধান করে।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, রেস এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির থেকে সংগৃহীত সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার সম্মিলিত মূল্যের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে।
তবে এই তহবিলগুলির সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী আমানতগুলো (এফডিআর) ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভাঙানো হয়েছিল বলে অভিযোগ, যার ফলে কোটি কোটি টাকার মুনাফা থেকে বঞ্চিত হন বিনিয়োগকারীরা।
এছাড়া তহবিলের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করার বদলে– নাফিজের বিভিন্ন আত্মীয়ের নামে শেয়ার কেনার জন্য নেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এভাবে তারা অর্থপাচার করে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকার মুনাফা বঞ্চিত করেছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অর্ন্তবর্তী সরকার বিগত ১৫ বছরের আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। তারই ধারাবাহিকতায় সিআইডির আর্থিকখাতে অনিয়মের অনুসন্ধানের বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমেকোর অর্থপাচারের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত (প্রাথমিক) প্রতিবেদন তুলে ধরে বিস্তারিত অনুসন্ধানের অনুমতি চাওয়া হয়।পরবর্তীতে সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিস্তারিত অনুসন্ধানের অনুমোদন দেন। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি টিবিএস পেয়েছে।
যেসব অভিযোগ সালমানের বিরুদ্ধে
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে বেক্সিমকো গ্রুপ গত ১৫ বছরে সাতটি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ঋণগ্রহণ করেছে।
এরমধ্যে জনতা ব্যাংক থেকে ২৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ২৯৫ কোটি টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও রুপালী ব্যাংক থেকে সম্মিলিতভাবে ৫ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা এবং বেসরকারি এবি ব্যাংক থেকে ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করছে। এসব টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিগত কয়েক বছরে (শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে) দৃশ্যমানভাবে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং অদৃশ্যভাবে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ছেলের কোম্পানির মাধ্যমে ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা পাচার
প্রতিবেদনে বলা হয়, সালমান এফ রহমানের বড় ছেলে সায়ান এফ রহমানের দুবাইয়ে আরআর গ্লোবাল ট্রেডিং নামে একটি বায়িং হাউজে মালিকানা রয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন ১৮টি কোম্পানির মাধ্যমে দুবাই ও সৌদি আরবে পণ্য রপ্তানি করেছে আরআর গ্লোবাল ট্রেডিং। যার রপ্তানি মূল্য ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। তবে এই টাকা বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা হয়নি, যা বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচার করেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে।
''সৌদি আরবে যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বেশিরভাগ অর্থ বাংলাদেশ থেকে ওভার-ইনভয়েসিং, আন্ডার-ইনভয়েসিং ও হুন্ডির মাধ্যমে নেয়া হয়েছে"- বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণপূর্বক আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করার অভিযোগে উক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগেই চলমান অপর একটি মানিলন্ডারিং অনুসন্ধানের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে শীঘ্রই মানিলন্ডারিং আইনে মোতাবেক মামলা করা হবে।