‘তারা ইয়ামিনকে দাদা কিংবা নানার পাশেও কবর দিতে দেয়নি’
পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে টেনে রাস্তায় নামিয়ে ফেলা হচ্ছিল এক তরুণের দেহ। তখনও শ্বাস চলছিল তার। এরপরেও আধা অচেতন অবস্থায় রাস্তায় নামিয়ে ফেলে রাখা হয় তাকে।
এমন বর্বরতার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে কেউই তা মেনে নিতে পারেননি। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় ওই যুবকের।
গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাভারে ধারণকৃত ওই ভিডিওর যুবক আস্-হা-বুল ইয়ামিন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)- এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সেদিন সাভারে পুলিশের এপিসি এবং সাঁজোয়া যান থেকে ছোঁড়া গুলিতে যখন আন্দোলনরত ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তখন ইয়ামিন দৌড়ে পালিয়ে না গিয়ে বরং সাহস করে ডিভাইডার টপকে পুলিশের এপিসি সাঁজোয়া যানের ওপরে উঠে পড়েন, এবং পুলিশকে সাধারণ ছাত্রদের দিকে টিয়ারশেল ছুঁড়তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
ঠিক তখনই তাকে নির্মমভাবে বুকে টার্গেট করে ঠান্ডা মাথায় 'বার্ডশট' করা হয়। এরপরেও জীবিত ছিলেন তিনি। ভিডিওতে দেখা যায়, যখন তাকে সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে টেনে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে হচ্ছে, তখনও শ্বাস নিচ্ছেন ইয়ামিন। তবে তাকে আর বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়নি, রাস্তাতেই ফেলে রাখা হয়।
ইয়ামিনের বাবা মো. মহি উদ্দিন বলেন, "ইয়ামিনের লাশ এনাম মেডিকেল থেকে বুঝে পাওয়ার পরে আমরা চেষ্টা করেছি কুষ্টিয়াতে আমার বাবা-মায়ের (ইয়ামিনের দাদা-দাদি) কবরের পাশে ইয়ামিনকে দাফন করতে; কিন্তু সেখানে আমার ভাতিজাকে থানা থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, সেখানে যেন তাদের অনুমতি ছাড়া লাশ দাফন না করা হয়।"
"পরে চেষ্টা করলাম সাভার পৌর গোরস্থানে ইয়ামিনের নানা-নানির কবরের পাশে কবর দেওয়ার জন্য; কিন্তু সেখানেও কবর দিতে বাঁধা দেয় পুলিশ। তারা বলে, পোস্টমার্টেম ছাড়া যেন সেখানে কোনো লাশ দাফন দেওয়া না হয়।"
তিনি বলেন, "কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি আমার ছেলেকে কোনোভাবেই পোস্টমার্টেম করাবো না। পরে আমি ব্যাংক টাউন সোসাইটি পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করি। মাগরিবের পরপরই দাফন করা হয়।"
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে সন্তান ইয়ামিনের স্মৃতিচারণ করে রোববার এমআইএসটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন ইয়ামিনের বাবা মহি উদ্দিন।
ইয়ামিনের বাবা বলেন, "ঘটনার দিন দুপুর ৩টার দিকে ওর (ইয়ামিন) ফোন কেউ একজন রিসিভ করে বললেন, 'আপনারা এনাম মেডিকেলে চলে আসেন।'"
আমি ও ইয়ামিনের মা গিয়ে হাসপাতালে ইয়ামিনকে নিচতলা, তিনতলায় খুঁজতে থাকি। নিচতলায় নামার সময় এক নার্স এসে ইয়ামিনের মাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন তিনি বলেন, 'আপনারা কি ইয়ামিনের মা-বাবা? চলেন নিচতলাতে ইয়ামিন আছে।' আমরা তখনও বুঝতে পারিনি যে ইয়ামিন বেঁচে নেই।"
"যখন নিচে একটি বদ্ধ রুম খুললো তখন দেখি স্ট্রেচারে ইয়ামিন শুয়ে আছে। একেবারে ঘুমন্ত মানুষের মতো, ডান পাশে মাথা হেলান দিয়ে সে শুয়ে আছে। তখন ডাক্তার আমাদের বলছিলেন যে, তারা চিকিৎসার কোনো সুযোগ পাননি। নিয়ে আসার আগেই মারা যায় ইয়ামিন। কিন্তু আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ইয়ামিন মারা গেছে। আমি বারবার পালস দেখার চেষ্টা করি। তার শরীর ঠান্ডাও হয়নি আবার শক্তও হয়নি," যোগ করেন ইয়ামিনের বাবা।
তিনি আরও বলেন, "আমরা ইয়ামিনের লাশ নিয়ে আসার চেষ্টা করি, কিন্তু পোস্টমার্টেম করতে চাওয়া হয় এবং লাশ নিয়ে আসতে বাঁধা দেওয়া হয়। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সহযোগীতায় ইয়ামিনের লাশ বাসায় নিয়ে আসি।"
"ইয়ামিন সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো এবং নিজের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায় মেনে নিতে পরতো না। ইয়ামিন বুয়েট ও রংপুর মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও পড়েনি, কারণ সে বলতো, 'আমি কোনো রাজনৈতিক ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে চাই না,'" বলেন মহি উদ্দিন।
ইয়ামিনের সাথে তার বাবার শেষ কথা হয় ঘটনার দিন (বৃহস্পতিবার) সকালে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যখন বাবাকে ইয়ামিন জিজ্ঞেস করেন, "বাবা, তোমার কি মিরপুরে কোনো হাসপাতাল পরিচিত আছে? আমার মিরপুরের কিছু বন্ধু আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়েছে, তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছে না। পরিচিত কেউ বলে দিলে ভর্তি নেবে।"
"তখন আমি তাকে বলি যে, আমার তো মিরপুরে ওভাবে কোনো পরিচিত হাসপাতাল নেই, কিন্তু টেকনিক্যালে হাসপাতাল আছে পরিচিত, ওখানে ভর্তি করতে পারো।"
"ইয়ামিন আমাকে প্রতিউত্তরে বলে, 'তোমার কাছে চাইলাম মিরপুরের হাসপাতালের সহযোগীতা আর তুমি দেখাও টেকনিক্যাল। তুমি তোমার কাজে যাও, আমি আমারটা দেখতেছি।' এটাই হচ্ছে আমার সাথে ওর শেষ কথা," বললেন ইয়ামিনের বাবা।
এমআইএসটির আরেক শিক্ষার্থী (প্রাক্তন) রাকিবুল হাসানও মিরপুরে গত ১৯ জুলাই গুলি লেগে মারা যান। তিনি তার কয়েকদিন আগ থেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু তার পরিবারের কেউই বিষয়টি জানতেন না।
এমআইএসটির এই দুই শহীদ ছাত্রের স্মৃতি রক্ষার্থে রোববার একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শহীদ আস্-হা-বুল ইয়ামিন এর নামে এমআইএসটি এর নব নির্মিত অডিটরিয়াম এবং শহীদ মো. রাকিবুল হাসান এর নামে এমআইএসটির এর মুক্ত মঞ্চের নামকরণ করা হয়।
এছাড়াও এমআইএসটির কেন্দ্রীয় পাঠাগারে শহীদ ইয়ামিন-শহীদ রাকিবুল কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
রাকিবুল হাসানের বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, রাকিবুল এমআইএসটি থেকে ২০১৯ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক পাশ করেন।
আবু বক্কর বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে রাকিবুল বিক্ষোভে জড়িত থাকলেও পরিবার তার অংশগ্রহণ সম্পর্কে অবগত ছিল না। ঘটনার সময় আহত এক নারীকে সাহায্য করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন রাকিবুল।
আবু বক্কর বলেন, "আমি জানিনা না কে গুলি চালিয়েছে, তবে আশা করি আমার নির্দোষ ছেলের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।"