আগস্ট ডায়েরি: এক আন্দোলনকারীর গল্প, যার আছে দুই ডানা
'ভাই হত্যার মাতম' নামে একটি প্রতীকী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল আগস্ট মাসের ২ তারিখ। গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ ছিল এর আয়োজক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বহু রক্ত ঝরেছে জুলাই মাসে। তার প্রতিবাদেই শিল্পী সমাজ নেমে এসেছিলেন রাস্তায়, আবাহনী মাঠের সামনে করেছিলেন ওই সমাবেশ।
সেদিন সারাদিন বৃষ্টি ঝরেছিল, কিন্তু দর্শনাথী ও অংশগ্রহণকারীর কমতি ছিল না। আয়োজনের অংশ ছিল একটি পাবলিক আর্ট। একটি বড় ক্যানভাস বিছানো হয়েছিল সমাবেশের মাঝখানে, মাইকে একজন করে শহীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল, শিল্পী ও জনতা সাড়া দিয়ে সমস্বরে বলছিলেন 'উপস্থিত'। তারপর নামটি লেখা হচ্ছিল ক্যানভাসে।
যারা পরিবেশন শিল্প বা পারফরমেন্স আর্ট করছিলেন, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ক্যানভাসের চারধারে। তাদের মুখ ও শরীর লাল রঙে রঞ্জিত ছিল। এ দলে ছিলেন রাসেল রানা। তিনি দুটি শুভ্র ডানা পিঠে বেঁধে এসেছিলেন, যেন স্বর্গের দূত!
শহীদদের নাম উচ্চারণ শেষ হলে পরিবেশন শিল্পীরা ক্যানভাসের ওপর বসে পড়ে জোরে জোরে রাস্তায় আঘাত করে বিলাপ করতে শুরু করেন। কেউ কেউ বলছিলেন, 'আবু সাঈদ, ভাই আমার কই গেলি রে? তোরে ছাড়া এখন ক্যামনে থাকি রে?'
এ পরিবেশনা উপস্থিত সবার মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। আসলেই যে আমাদের ভাইয়েরা, ছেলেরা মারা গেছেন— তার কষ্ট, দুঃখ সবার মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছিল।
সবাই স্বাধীনতা চায়
বিলাপ শেষ হলে লাল রঙ দিয়ে স্বর্গের দূত প্রতীকের রাসেল রানাকে গোসল করিয়ে দেওয়া হয়, যার মানে দাঁড়াল স্বৈরাচার স্বর্গের দূতকেও রক্তে রঞ্জিত করেছে।
তারপর সমাবেশ থেকে একটি মিছিল বের হয়ে ধানমন্ডি শংকর পর্যন্ত যায়। তখন কয়েকজন পথশিশু রাসেলকে সত্যিকারের পরী ভেবে অবাক হয়েছিল। একজনকে রাসেল ডানাগুলো খুলে পরতে দিয়েছিল। দেখা গেল সে দৌড়ে গেল, উড়ে যাওয়ার ভাবও করল। বোঝা গেল স্বাধীনতা সবাই চায়।
২০১৬ সালের দিকে রাসেল, পরিবেশনা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি তখন ঢাকা চারুকলার ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগে অধ্যয়নরত। তিনি দেখলেন, এর মাধ্যমে সরাসরি দর্শকের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়। রাসেল প্রান্তিক মানুষের পক্ষে আওয়াজ তুলতে চান, বিভেদ দূর করতে চান, অন্যায়-অবিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে চান, পরিবেশনা শিল্প তার এই চাওয়াগুলো মানুষের কাছে দ্রুতই পৌঁছাতে সাহায্য করে।
পরাবাস্তবধর্মী চিত্রকলার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বরাবর। নিজের ক্যানভাসেও তিনি সুদৃশ্য এক স্বপ্নিল পৃথিবীর প্রকাশ ঘটান। তাই পরিবেশনা শিল্পের প্রপস হিসাবে বেছে নেন দুটি শুভ্র ডানা, নিজেকে প্রকাশ করেন পরী বা 'অ্যাঞ্জেল' হিসাবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশ গুলি চালানোর পর পরই জুলাইয়ের মাঝামাঝি একদিনে রাসেল রাজু ভাস্কর্যের সামনে একটি পরিবেশনা শিল্প উপস্থাপনের পরিকল্পনা করেন। সঙ্গে যোগ দিতে জুনিয়র কয়েকজন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানান।
এদিনের পরিকল্পনা ছিল, একটি স্বর্গীয় দূতের চারধারে নৃত্য করছে কালো কাপড়ে আবৃত কিছু অপশক্তি। তবে স্বর্গীয় দূতের আভায় আলোকিত হয়ে একপর্যায়ে তারা কালো পোশাক ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং দূতের সঙ্গে একাত্ম হয়।
রাত আনত বিষণ্নতা
পারফরম্যান্সটি অবশ্য করা যায়নি, কারণ কয়েকজন বড় ভাই মারফত খবর পেয়েছিলেন যে হামলা হতে পারে। রানা তখন ভাবলেন, নিজের কথা না হয় বাদ, কিন্তু জুনিয়ররা আছে; তাদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না।
এরপর ক্যাম্পাস পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, জারি হয় কারফিউ। তবে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিলে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি রাসেল রানা। সারাদিন আন্দোলন-সংগ্রামে কেটে গেলেও আসল সমস্যা হতো রাতে। কিছুতেই ঘুম আসতে চাইত না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহীদ ছাত্র-জনতার কথা মনে পড়ত, আর মন খারাপ হয়ে থাকত। তখন রাসেল ছবি আঁকতে চাইতেন, কিন্তু ক্যানভাসে আঁচড় কাটতে পারতেন না। এক অস্থিরতা, অসহায়ত্ব তাকে ঘিরে থাকত সারারাত।
একটা সময় ফোনে মেসেজ আসতে থাকল, 'এখনো সময় আছে সাবধান হও। যাদের শায়েস্তা করা হবে, তাদের মধ্যে তোমার নামও আছে।' আবেগ, উৎকণ্ঠার সঙ্গে এবার ভয়ও জেঁকে বসল মনে। একটু শব্দ হলেই কেঁপে উঠতেন, মনে হতো এই বুঝি দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হবে।
রাসেল বলছিলেন, "রাত একটু গভীর হলেই একেবারে একা, বিষণ্ন হয়ে যেতাম। দিনে পারফরম্যান্স যখন করতাম, তখন আমার ভেতরের আবেগ সব উজাড় করে দিতে পারতাম, সব আবেগ উপচে বেরিয়ে আসতো। কিন্তু রাতে ছবি আঁকতে পারছিলাম না একটুও। এতোই অসহায় লাগত যে বলার নয়। তিন-চার রাত ঘুম হলো না। স্টুডিওতে বসে একদিন খুব কাঁদলাম, তারপর ভাবলাম, দেশের জন্য যদি মরতে হয় তবে মরব, ভয় পেয়ে কী হবে! তখন মনটা একটু সুস্থির হলো।"
কপালে লাল সূর্য
৩ আগস্ট বিকালে শহীদ মিনারে ছিল ছাত্র জনতার সমাবেশ। আগের ডানা দুটি লাল হয়ে যাওয়ায় রানা দুটি নতুন ডানা বানালেন। সেগুলো পরা যেত হাতে। ডানা ঝাপটালে মনে হতো তিনি উড়ছেন। হাতে ডানা লাগিয়ে সমাবেশে যখন হাজির হলেন, তখন তার পরনেও ছিল সাদা পোশাক, মুখে সাদা রং মাখা, কপালে লাল সূর্য আঁকা। ডান চোখেও লাল রঙের ফোঁটা যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ডানা ঝাপটিয়ে তিনি ছুটছিলেন শহীদ মিনারের এদিক থেকে ওদিক, পিছনে পিছনে অনেক লোক।
মনে হচ্ছিল সবাই চাইছেন স্বাধীনতা, সবাই চাইছেন মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার পরিবেশনা শিল্পের সঙ্গে সহস্র মানুষ একাত্ম হয়েছিল।
পরের দিন ৪ আগস্ট পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল পুলিশ ও ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী। আগের রাতে এক শিক্ষক মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশ হবে শাহবাগে, রাসেল যেন হাজির থাকে। এই কথা সমমনা আরও অনেককে জানিয়ে দিয়েছিলেন রাসেল। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে পেটোয়া বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে শাহবাগ পৌঁছাতে আধঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখেন, সে শিক্ষকের কোনো পাত্তা নেই। শাহবাগ মোড়ে ছাত্রলীগ আর পুলিশ।
এর মধ্যে একজন সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে ওরা চোখ নষ্ট করে দিল। রাসেল তার সঙ্গীকে একটি অটো রিকশায় উঠিয়ে কাঁটাবন মোড়ের দিকে ছুটলেন। পিছু পিছু ছাত্রলীগের ছেলেরা ধাওয়া করে অনেকদূর চলে এসেছিল। কিন্তু রিকশার গতি বেশি হওয়ায় রাসেলরা পার পেয়ে গিয়েছিলেন।
এর মধ্যে রানা সেই শিক্ষককে ফোন দিচ্ছিলেন, মেসেজ দিচ্ছিলেন— কিন্তু কোনো রিপ্লাই পাচ্ছিলেন না। পরে জানতে পেরেছেন, পুরোটাই ছিল একটা ট্র্যাপ বা ফাঁদ। ওই শিক্ষক মূলত নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তিনি চাইছিলেন, ছাত্র-শিক্ষকরা পেটোয়া বাহিনীর হাতে পড়ে রক্তাক্ত হোক, তবে তার দল ফায়দা লুটতে পারবে। এরপর ৪ তারিখে রাসেলের আর কিছু করা হয়ে ওঠেনি।
ডানা মেলে দিলেন
৫ আগস্ট পরিস্থিতি দুপুরের আগে পর্যন্ত ছিল থমথমে। ৩ আগস্ট গণভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি এতোটাই কঠোর করে রেখেছিল যে, রাসেল বের হতে পারেননি। পরে যখন জানতে পারলেন শেখ হাসিনা পালাচ্ছেন, তখন শাহবাগ চলে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন তার ডানাগুলো। আজ বুঝি সত্যি মুক্তি আসছে। কিছুক্ষণ পর জানা গেল শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। ডানা মেলে ঝাপটাতে লাগলেন রানা। পিছু পিছু অনেকজন।
বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা তখন শাহবাগ। কিছু পরে রওনা হলেন গণভবনের দিকে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কাছে গিয়ে যখন ধোয়া দেখলেন তখন বিজয়ের উল্লাস মাতমে পরিণত হলো। তিনি ও তার বন্ধুরা কয়েকজনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
বললেন, "এটি জাতীয় সম্পদ, এখানে অনেক ঐতিহাসিক দলিল আছে, এগুলো নতুন প্রজন্মের কাজে লাগবে।" লোকগুলো কথা তো শোনেইনি বরং তেড়ে মারতে এসেছে। তারপর বেদনার্ত মন নিয়ে গণভবন গিয়ে জনতার কাণ্ড দেখে আরও মুষড়ে পড়লেন। বেশিক্ষণ সেখানে থাকেননি, ফেরার পথে ধানমন্ডি লেকের কাছে বন্ধুদের নিয়ে চুপচাপ বসেছিলেন অনেকটা সময়। আপন মনে শুধু বলেছিলেন, 'এ জন্যই কি এতো রক্ত দান? এমন কাণ্ডকে বিজয় বলা চলে?'
পরের কয়েকদিন নানা জায়গা থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর পেতে থাকলেন। সহপাঠীদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল তারাও বলতে থাকলেন, এ তোরা কী করলি? এখন তো ঘরেই থাকতে পারছি না। রাসেল অবশ্য সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতনের বিষয়গুলো যাচাই করে নিতে থাকলেন এবং বুঝতে পারলেন সব তথ্য সঠিক নয়।
এর মধ্যে এলো ১৭ আগস্ট। কলকাতায় নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও 'মেয়েরা রাত দখল করো' কর্মসূচি পালন করলেন। এই কর্মসূচিতেও রাসেল তার ডানা দুটি ঝাপটে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'ফ্রিডম চাই, ফ্রিডম ফর উইমেন'।
বন্যার ত্রাণ সংগ্রহে
এমন সময় এলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর। হঠাৎই বন্যা আঘাত হানে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। তীব্র আকার ধারণ করে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি। রাসেল তার সিনিয়র ও জুনিয়র শিল্পীদের সঙ্গে মিলে ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানে নামলেন। চারুকলায় চললো ত্রাণ সংগ্রহ অভিযান। ছবি এঁকে, পাপেট শো দেখিয়ে, ছবি বিক্রি করে বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান শুকনো খাবার, চাল, ডাল, পোশাক, ওষুধ, খাবার পানি পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবীদের এক সভায় রাসেল স্যানিটারি প্যাড সংগ্রহের প্রসঙ্গ তুললেন। অনেকেই উৎসাহ দেখালেন, এক দুজন শুধু বললেন, "এগুলো ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তাদের আছে কি–না আর এই সময় এগুলো কতটা প্রয়োজনীয়?"
রাসেল বললেন, "এই ক্রান্তিলগ্নে বেঁচে থাকা যেমন জরুরি, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।" এরপর সবাই সম্মত হলে বেসরকারি এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান মেয়ে নেটওয়ার্কের কাছে স্যানিটারি প্যাড চেয়ে আবেদন করলেন রাসেল।
প্রাথমিকভাবে ১,০০০ প্যাকেট চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান ব্যাপারটি খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে, তারা ১,৩০০ প্যাকেট সরবরাহ করে। ইতোমধ্যে সংগৃহীত ত্রাণ-সামগ্রী নিয়ে চারুকলার একটি দল ফেনীর সিলোনিয়ায় গিয়েছে। তারা আগে থেকেই খবর নিয়েছে, কোথায় ত্রাণ একেবারেই পৌঁছায়নি। সেসব জায়গাতেই ত্রাণ পৌঁছানোই তাদের লক্ষ্য। পানি নেমে যাওয়ার পর পুনর্বাসনেও কাজ করবে দলটি।