ঋণ দিতে রাজি হননি, ‘জোরপূর্বক’ তাকে পদত্যাগ করান রউফ তালুকদার ও সালমান: অভিযোগ সাবেক বিআইএফএফএল সিইওর; মামলা
সাবেক অর্থ সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিইও ফরমানুল ইসলাম। মামলায় এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিআইএফএফএল বোর্ডের সদস্য আবু হেনা রহমাতুল মুনীমসহ নয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার নথিতে ফরমানুল বলেছেন, সালমানের জন্য ঋণ অনুমোদন করতে রাজি না হওয়ায় তাকে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তার অভিযোগ, ২০১৯ সালে রউফ তালুকদার তাকে ঋণ অনুমোদনের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। থানায় অভিযোগ করা হলেও কোনো তদন্ত হয়নি।
আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআইকে) অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
যেভাবে ফরমানুলকে 'উৎখাত' করা হয়েছিল
২০১৯ সালের ৮ জুলাই বিআইএফএফএলের নির্বাহী পরিচালক ও সিইও ফরমানুল ইসলাম আর দশটা দিনের মতোই তার অফিসে কাজ করছিলেন।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিআইএফএফএল দেশে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন করে। ফরমানুল অবশ্য জানতেন, এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের দায়ভার যেহেতু নিয়েছেন, তাই তাকে নানা দিকের অনেক চাপ সামলাতে হবে।
তবে ৮ জুলাই দিনটি অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। তৎকালীন অর্থসচিব ও বিআইএফএফএল-এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদারের ব্যক্তিগত সচিব একটি জরুরি বৈঠকে অংশ নিতে ফরমানুলকে অনুরোধ করেন।
ফরমানুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বৈঠকে অংশ নেওয়ার অনুরোধ পেয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ে ছুটে যান। সেখানে সচিবের কার্যালয়ের বাইরে অপেক্ষা করেন কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে আব্দুর রউফ তালুকদার তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেই ফরমানুলকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি নাফিজ সরাফাতকে চেনেন?'
ফরমানুল জানালেন, তিনি ওনাকে চেনেন না। সে উত্তরে অর্থ সচিব মনক্ষুণ্ণ হলেন।
'আপনি ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে চেনেন না?' রউফ তালুকদার চাপা আর অধৈর্য গলায় বলে উঠলেন। ফরমানুল কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর নাফিজ সরাফাত সেখানে এলেন। এ প্রথম তাকে সরাসরি দেখলেন ফরমানুল ইসলাম। একটু পরেই ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে কেতাদুরস্ত হয়ে উদয় হলেন 'দরবেশ' ওরফে সালমান এফ রহমান।
কয়েক মিনিট পর ফরমানুলকে সচিবের কক্ষে ডাকা হলো। ভেতরে একটি সোফার তিনপাশে তারা তিনজন বসে আছেন। আরেক পাশে ফরমানুলকে বসার ইঙ্গিত করলেন তারা।
রউফ তালুকদার ফরমানুলকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলে সালমান বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, 'আমি ওনাকে চিনি।'
তারপর ফরমানুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আপনি বিআইএফএফএল খুব ভালো চালাচ্ছেন। তা আমাদের ২০০ মেগাওয়াট তিস্তা সৌর প্রকল্পের জন্য ১৮৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন লাগবে। আপনাকে এটা দিতে হবে।'
'এ প্রকল্পটির পিপিএ [পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট] রেট প্রতি ইউনিটে ১৭ সেন্ট। এটা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ এবং বাণিজ্যিকভাবে খুব ভায়াবল,' তিনি আরও বলেন।
এ বৈঠকের আগে থেকেই তিস্তা সোলার প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিআইএফএফএল-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছিলেন।
প্রকল্পটির জন্য ফরমানুল এবং তার দল সম্ভাব্য অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও আলোচনা করছিলেন। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে তিস্তা প্রকল্পের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশ্বব্যাংক দলের সঙ্গে একটি বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বৈঠকের আগেরদিন বিশ্বব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সরলমনে ফরমানুলের কাছে জানতে চান প্রকল্পের ক্রয়প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক ছিল কি না।
ফরমানুল যখন স্বীকার করেন যে তেমনটা হয়নি, তখন বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, প্রতিযোগিতামূলক ক্রয়প্রক্রিয়া না থাকায় নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তারা এ প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করতে পারবে না।
ফরমানুল বিষয়টি তিস্তা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের জানান। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, সালমান এফ রহমান প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো উপায় খুঁজে বের করবেন।
ফরমানুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমার বিশ্বাস, বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারবে না জানার পর সালমান এফ রহমান আমার ও বিআইএফএফএল-এর ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য অর্থসচিবের কার্যালয়ে ওই বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন।'
বৈঠকের এক পর্যায়ে ফরমানুল বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করে জানতে চান, প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক ছিল কি না।
সালমান এমন কিছু হয়নি বলে অকপটে স্বীকার করেন। অর্থাৎ ট্রিনা সোলারের ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া ছিল না। ফলে কেবল বিশ্বব্যাংকই নয়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পক্ষেও এ প্রকল্পে অর্থায়নের সুযোগ নেই।
কিন্তু তারপরও সালমান এফ রহমান প্রকল্পের তহবিলের অর্থায়ন বিআইএফএফএলকে করতে বলেন।
ফরমানুল জানান, এত বড় অর্থায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল তার সংস্থার নেই। তাছাড়া একক ঋণগ্রহীতার জন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেওয়ার সীমা তিস্তা সৌর প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ১৮৫ মিলিয়ন ডলারের (তৎকালীন দেড় হাজার কোটি টাকা) চেয়ে অনেক কম।
ফরমানুল ইসলাম তখন উভয় সংকটে — একদিকে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার কঠোর নীতি, অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তির অনড় দাবি।
সালমান তখন সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কৌশলে পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর জন্য ফরমানুল বললেন, 'সরকারি ব্যাংকগুলো আপনার কথা শুনবে। আপনি ১,৪০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে তাদের বলতে পারেন সাবস্ক্রাইব করতে।' এ কথা শুনে সালমান এফ রহমান খুশি হয়ে বললেন, 'ভালো বলেছেন। আমি সে ব্যবস্থা করছি, তবে আপনি আগে ২০০ কোটি দেন।'
আব্দুর রউফ তালুকদার নীরব দর্শক হয়ে বসে ছিলেন। ফরমানুল সালমানকে বললেন, তাদের অনেকগুলো ঋণ প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে, তারা ২০০ কোটি টাকা দিতে পারব না। তবে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিবেচনা করা যেতে পারে—এবং তাও বন্ড অনুমোদন হওয়ার এবং সম্পূর্ণ অর্থায়নের পর।
তখনি রউফ তালুকদারের ভাবভঙ্গি বদলে যায়। তিনি রেগে গিয়ে উঁচু গলায় নির্দেশ দিলেন, 'আপনি বোর্ড মিটিংয়ে ২০০ কোটি প্রস্তাব করেন, বাকিটা আমি দেখব।'
এর পরপরই সালমান আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে ফরমানুলকে বলেন, 'আচ্ছা, আপনি আমার তৈরি পোশাকের জাইকা ফান্ডটা তো [৪০ কোটি টাকা] এখনো দিলেন না!' জবাবে ফরমান বললেন, 'আমাদের দিতে তো অসুবিধা নেই, কিন্তু আপনার সব সিস্টার কনসার্নসের সিআইবি রিপোর্ট দুর্বল। সবই ক্লাসিফায়েড। যার কারণে এ ঋণ প্রক্রিয়াকরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।' সালমান দ্রুত পালটা বলেন, 'আমি হাইকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার পেয়েছি, তাই আপনারা এখন সিআইবি রিপোর্ট খালি পাবেন।'
ফরমানুল তখন বলেন, 'সেখানে কিন্তু একটা মন্তব্য থাকে যে, আদালতের স্টে অর্ডার দেওয়ার কারণে সিআইবি রিপোর্ট দেখানো যাচ্ছে না এবং সেটাও এক ধরনের কোয়ালিফিকেশন।' এ কথায় রউফ তালুকদার ফরমানুলের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। ফরমানুল প্রসঙ্গ পালটিয়ে দরবেশকে জানালালেন, তার প্রকল্পের স্রেডা [টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ]-এর অনাপত্তিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেটা নবায়ন না করলে ঋণ বিবেচনা করতে পারবেন না। সালমান আশ্বস্ত করে বললেন, সেটা তিনি অতি দ্রুত করে দেবেন।
এরপর আলোচনার আর কোনো বিষয় না থাকায় ফরমানুল সেখান থেকে চলে আসেন।
এর বিশ দিন পর, ২৮ জুলাই বোর্ড মিটিংয়ে ফরমানুলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। বোর্ডের সব সদস্য উপস্থিত না থাকলেও রউফ তালুকদার তাকে একটি খালি কাগজ দেন এবং পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলেন।
ফরমানুল তার চাকরির শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তিন মাসের নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন অর্থসচিব এবং বিআইএফএফএল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার জোর দিয়েছিলেন, তিনি যেন তখুনি পদত্যাগ করে অফিস থেকে বেরিয়ে যান এবং আর ওমুখো না হন।
যে অফিসে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে সিইও হিসেবে কাজ করেছে, ফরমানুলকে সেখান থেকে চলে আসতে হলো। 'আমার একটা ব্লেজার অফিস থেকে আনার জন্যও অফিসে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়নি।'
কিন্তু ফরমানুলের দুর্ভোগ সেখানেই শেষ হয়নি।
আব্দুর রউফ তালুকদার ফরমানুলের মোবাইল ফোনের সিমকার্ড ও ইমেইল ব্লক করার ব্যবস্থা করেন। তার গাড়ির চাবিও তাৎক্ষণিক বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এক সপ্তাহ পর ফরমানুল চিকিৎসার কারণে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার পথেও বাধা পান। ঢাকা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়, অর্থসচিব রউফ তালুকদার তার ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।
ফরমানুল বলেন, তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর সালমান এফ রহমান বিআইএফএফএল থেকে জামানত ছাড়াই জাইকা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন। অথচ ফরমানুল থাকাকালীন প্রাথমিকভাবে ৪০ কোটি টাকা চেয়েছিলেন সালমান। 'এটা আব্দুর রউফ তালুকদার এবং তৎকালীন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা ছাড়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে তদন্ত প্রয়োজন,' বলেন ফরমানুল।