বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরপরই অক্টোবর–ডিসেম্বরে কেন প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় হয়?
এ বছর বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর। তবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ থেকে গঠিত ঘূর্ণিঝড় 'দানা'-এর প্রভাব এখন অনুভূত হচ্ছে। ভারতের স্থলভাগে এটি আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বাতাস ও স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রভাব দেখা দিয়েছে।
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৮৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত বহুবার এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ মাসগুলোতে ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ও ঘূর্ণিঝড় গবেষক আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭৪টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'গত ১৩৩ বছরে নভেম্বরে ১৩৩টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, যার মধ্যে অক্টোবরে ৯৪টি এবং ডিসেম্বর মাসে ৫৫টি রেকর্ড করা হয়েছে।'
অক্টোবরের দিকে ঘূর্ণিঝড় বৃদ্ধির প্রবণতা
যদিও দীর্ঘমেয়াদে নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বেশি দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অক্টোবরেও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। মল্লিক বলেন, ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে একসঙ্গে তিনটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি বাংলাদেশে আঘাত হানে—একটি কক্সবাজারে এবং অন্যটি সন্দ্বীপের হাতিয়ায়। বাকি ঘূর্ণিঝড়টি শ্রীলঙ্কায় আঘাত করেছিল।
সম্প্রতি ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় 'হামুন' ২১ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছিল। একইভাবে, ২০২২ সালে 'সিত্রাং' ২২ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আঘাত হেনে সন্দ্বীপে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে।
এ বছরের ঘূর্ণিঝড় 'দানা'ও ২২ অক্টোবর গঠিত হয়েছে। আগামীকাল ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত এটির প্রভাব সক্রিয় থাকার কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একই সময়ে ধারাবাহিকভাবে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
বর্ষা-পরবর্তী প্রভাব
আবহাওয়াবিদ মল্লিক জানান, বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড়ের গঠনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন, 'সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ দিবারাত্রি সমান হয় এবং এরপর সূর্যের আলো তীর্যকভাবে সাগরে পড়তে শুরু করে, যা সাগরের পানি দ্রুত উষ্ণ করে তোলে।
'এ কারণে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সাগরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় পানির বাষ্পায়ন বাড়ে এবং ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।'
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক এবং পানির গভীরতার কমপক্ষে ৫০ মিটার পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। আর অক্টোবরে এ তাপমাত্রা খুব সহজেই অতিক্রম করে যায়।'
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ার ক্ষেত্রে সমুদ্রের তাপমাত্রার প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি বলেন, 'বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে আবহাওয়াবিদেরা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রার মানচিত্র বিশ্লেষণ করেন। গরম পানি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করে।'
তিনি আরও বলেন, 'অক্টোবরের ২২ তারিখ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল, বিশেষত ওড়িশা উপকূলের কাছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় দানা ওড়িশা উপকূলেই আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি।'