পানি নিয়ে নতুন লড়াই শুরু করছে চীন ও ভারত
হিমালয়ে আজ সাত মাস ধরে মুখোমুখি অবস্থানে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্কও তার ফলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকে। এর মধ্যেই দেশদুটির সম্পর্ক আরো উত্তেজনাময় হতে চলেছে নতুন এক ইস্যু: পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
পারস্পরিক অবিশ্বাস, স্বচ্ছতার অভাব এবং আঞ্চলিক প্রভাবের তীব্র প্রতিযোগিতা-ই এই উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। তৈরি হতে পারে সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র। কারণ পৃথিবীর অন্যতম বড় এক নদের উপর বাঁধ দিতে চাইছে চীন।
ভারত আর বাংলাদেশে সেই নদ ব্রহ্মপুত্র আর চীনে ইয়ারলুং-জ্যাংবো নামেই পরিচিত।
গত মাসেই বেইজিং নদের উজানে নিজ অংশে বা ভারতের ভাটির মুখে তার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দেয়। নির্মাণ সম্পন্ন হলে বর্তমানে চীনের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প 'থ্রি গর্জেস ড্যাম' থেকেও তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদিত হবে। ফলে এটিই হবে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ ও পানির স্রোতকে বিদ্যুতে রূপদানের উদ্যোগ।
চীনের ইংরেজি ভাষার দৈনিক ও কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস, রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার কর্পোরেশন অব চায়না'র চেয়ারম্যান ইয়ান ঝিয়ং- এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ৭ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। তিনি একে 'ইতিহাসে অদ্বিতীয়' এক প্রকল্প বলেও উল্লেখ করেন।
বেইজিং অবশ্য বাঁধটি কোথায় নির্মিত হবে- তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেনি। কিন্তু, ধারণা করা হচ্ছে 'গ্রেট বেন্ড' নামে পরিচিত পাহাড়ি খাদে ঘেরা বাঁকেই এটি নির্মিত হবে। জ্যাংবো এখানেই বাঁক নিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করেছে।
ভারত তার স্বাধীনতার পর থেকেই নদ-নদীর উপর শত শত বাঁধ নির্মাণ করে এসেছে। তাই উজানে বাঁধ নির্মাণে ভাটি অঞ্চলে পড়া প্রতিকূল প্রভাব সম্পর্কে তার ভালোই জানা আছে। এর ফলে যে ভাটিতে আকস্মিক বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে ক্ষরা দেখা দেবে সে সম্পর্কেও নয়াদিল্লি জানে। তাই দেশটির নীতি-নির্ধারকদের উদ্বেগ; চীনা প্রকল্পের কারণেও ভারতের পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
তাছাড়া, বাঁধের নিয়ন্ত্রণ থাকায় চাইলেই ভারতকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে মতো বন্যা বা ক্ষরার মতো সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে বেইজিং। যৌথ নদীতে প্রতিবেশীর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে তাই দিল্লির উদ্বেগ অমূলক নয়।
তাইতো চীনা ঘোষণার দুইদিন পরই নয়াদিল্লি ব্রহ্মপুত্র নদের উপর একটি বাঁধ নির্মাণের পাল্টা পরিকল্পনার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানায়। এটিও হবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের কেন্দ্রীয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থাকে রয়টার্সকে বলেন, এর ফলে 'চীনা স্থাপনার প্রতিকূল প্রভাবকে সীমিত রাখা সম্ভব হবে।'
চীন বিশেষজ্ঞ এবং জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক বি.আর. দীপক বলেন, 'হিমালয়ে সীমান্ত সংঘাত আর তারপর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দুই দেশের রহস্য এবং লুকোচুরি করার প্রবণতা, তার সঙ্গে উত্তেজনাকর তথ্য- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নাজুক রূপ নিচ্ছে।'
নয়াদিল্লি উত্তেজনাকর বক্তব্যের মাধ্যমে চীনকে উস্কে না দেওয়ার ব্যাপারে আপাতত সতর্ক বলেই দেখা যাচ্ছে। কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া অন্তত সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।
যেমন, গত বৃহস্পতিবার ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ''আমরা নদের উপর চলমান সব ধরনের উন্নয়ন কাজকে সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছি। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগের বিষয়টি চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত তুলে ধরা হয়েছে। উজানে তাদের কোনো প্রকল্পে ভাটিতে অবস্থিত দেশসমূহ যেন ক্ষতির শিকার না হয়- আমরা সেই দাবিও তুলেছি।'
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের প্রকল্প ঘিরে ভারতের দুর্ভাবনা বাড়তেই থাকবে। ইতোমধ্যেই, ভারতীয় গণমাধ্যম নয়া বাঁধকে 'সুপার ড্যাম' নাম দিয়ে ভীতি সৃষ্টিকারী সংবাদ পরিবেশন করছে।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জুনিয়র ফেলো সায়াংশু মোদক একজন আন্তসীমান্ত নদী শাসন ও বন্যা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। তার মতে, বেইজিং প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে গেলে তা অবশ্যই ভারতের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে।
'পাহাড়ি এই অঞ্চল বেশ ভূমিকম্প প্রবণ। টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধিতে সেখানে প্রায়শ'ই তুষার ও ভূমি ধ্বসের মতো ঘটনাও ঘটে। এমন কোনো দুর্ঘটনায় যদি বাঁধটি ভেঙ্গে যায় তাহলেও এটি ভাটিতে ধবংসের তাণ্ডব বইয়ে দেবে। উজানে থাকায় এতে চীনের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে ভারত যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়বে,' মোদক বলছিলেন।
তিনি আরো জানান, বাঁধের নিয়ন্ত্রণ থাকার অর্থ বর্ষার মতো মৌসুমে একসঙ্গে জমা থাকা পানি প্রবাহ ছেড়ে দিয়েও ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি করতে পারবে বেইজিং।
২০১৩ সালে প্রকাশিত ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজের অপ্রচলিত যুদ্ধ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী গবেষণা কেন্দ্রের এক গবেষণাপত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ব্রহ্মপুত্রে 'সুপার ড্যাম' নির্মাণের মাধ্যমে চীন তার বিরূপ প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ধ্বংসলীলা চালাতে পারবে। একে শত্রুর বিরুদ্ধে 'মানসিক ও স্নায়বিক' যুদ্ধ কৌশল বলেই সেখানে উল্লেখ করা হয়।
মার্কিন গবেষণা আরো জানায়, ব্রহ্মপুত্রের উপর বাঁধ দিয়ে চীন উত্তরপূর্ব ভারতের বিশাল অঞ্চল জুড়ে কৃষিকাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে। ফলে দেখা দেবে বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক দৈন্যতা, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও যোগ হবে নতুন ডামাডোল।
''বাঁধটি তৈরি হয়ে গেলে ভারত ও বাংলাদেশে মানবিক পর্যায়ে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। চাষাবাদে পানির অভাবের ফলে দেখা দেবে খাদ্যের সঙ্কট। প্রাকৃতিক পরিবেশেও নামবে বিপর্যয়। ফলে বেইজিংয়ের করা যেকোনো অনুরোধ দেশদুটির পক্ষে উপেক্ষা করাও সম্ভব হবে না,'' এসব কথা তুলে ধরে গবেষণাপত্রে এ পরিস্থিতিকে ভারতের 'অস্তিত্বের জন্যই হুমকি' বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট