রোহিঙ্গা শিবিরে সংস্কৃতি চর্চা
মোহাম্মদ এরশাদ। বয়স ১০৮। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এক রোহিঙ্গা শরণার্থী।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, নিজের চার সন্তানের নাম প্রায়ই ভুলে গেলেও ২০১৭ সালের ২৮ আগস্টের কথা কখনোই ভুলতে পারবেন না। সেদিন মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার মতো হাজারও মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল।
'এখনো সেই গুলির শব্দ আমার কানে ভাসে। একদিকে মিলিটারিদের গোলাগুলি, অন্যদিকে মানুষ যে যেখানে পারছে ছুটছে,' আরব নিউজকে বলেন মোহাম্মদ এরশাদ।
তিনি আরও বলেন, 'আমি স্বজন ও প্রতিবেশীদের বলছিলাম, যার যা কিছু মূল্যবান জিনিস আছে, তা নিয়েই তোমরা এখান থেকে চলে যাও।'
সেদিন চলে আসার সময় তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন শুধু তার ক্যালিগ্রাফির বইটি। 'এটাই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। ক্যালিগ্রাফি আমার জীবন।'
ক্যালিগ্রাফিতে তার অসাধারণ দক্ষতার জন্য বালুখালি শিবিরে তিনি 'জীবন্ত কিংবদন্তি' হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে এত প্রতিকূলতার মাঝেও ক্যালিগ্রাফি করে যাচ্ছেন।
'যখন আমার ক্যালিগ্রাফির বইটি নিয়ে বসি, মনে হয় যেন মাতৃভূমিতে ফিরে গেছি। শিবিরের এতসব সমস্যার ভিড়েও প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে আমি লিখি,' বলেন এরশাদ। তার বেশিরভাগ লেখাই ইসলামি গল্প ও হাদিস নিয়ে।
মোহাম্মদ এরশাদের জন্ম মিয়ানমারের উদাংপারা গ্রামে, ১৯১২ সালে। ভারতের উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি হাদিস বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন।১৯৬২-৬৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের জাতীয় রেডিওতে পবিত্র কোরআন শরীফ তিলোয়াত করতেন। মিয়ানমারের একটি মাদ্রাসায়ও পড়াতেন তিনি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি মিয়ানমারের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সনদপত্রের কাজও করেছেন বহু বছর।
তিনি এখন সন্তানদের মাঝে এই দক্ষতা ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। যেন তার মৃত্যুর পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে।
'আমার বড় ছেলে আমার কাছ থেকে ক্যালিগ্রাফি শিখেছে। মেয়েকেও শিখিয়েছি, যদিও তার নামটি ঠিক মনে করতে পারছি না এখন,' অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন।
এরশাদ আরও বলেন, 'রাখাইনে শেষ দিন পর্যন্ত যা যা হয়েছে, সব আমাকে লিখে যেতে হবে। এর জন্য আমি আলাদা ডায়েরিও করেছি।'
কক্সবাজার শিবিরের হাজার হাজার শরণার্থীর মাঝে এরশাদ একজন, যিনি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে তাদের সৃজনশীল অভিব্যক্তি ব্যবহার করছেন।
অতীতের ঘটনাবলীর মানসিক আঘাত স্মরণ করে বালুখালি শিবিরের আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী কাওয়ালি গায়িকা বশিরুল্লাহ (৬০) জানান, তার সংগীত ছিল বাস্তবতা থেকে অব্যাহতি নেওয়ার উপায়।
ঐতিহ্যবাহী তারানা সংগীতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী বশিরুল্লাহ। একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অবিচ্ছিন্ন গীত তৈরি করা যে সংগীতের রেওয়াজ। শিবিরের শরণার্থীদের কাছে এই ঘরানার সংগীত এখনো জনপ্রিয়।
'গানের বিষয়গুলো হরদমই আমাদের প্রতিদিনের জীবনের আনন্দের মুহূর্তগুলো নিয়ে হয়ে থাকে। যেমন, বিবাহ, সন্তানের জন্ম ইত্যাদি।'
যদিও এখনকার গানগুলো আনন্দ ও খুশি ঘিরে হয় না। তবু গানগুলোতে মিশে রয়েছে তাদের জন্মভূমির স্মৃতি।
বশিরুল্লাহ বলেন, '২০১৭ সালের সেই মর্মান্তিক হামলায় আমার অনেক আত্মীয় ও প্রতিবেশীর মৃত্যুর সাক্ষী আমি। আমার পরিবারের ১০ সদস্যসহ আমি এখানে চলে এসেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার কোনো সন্তানই সংগীতের প্রতি আগ্রহী নয়।'
মংডু জনপদের মংলিপাড়া গ্রামে বশিরুল্লাহর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তার আগ্রহ ছিল।
বালুখালি শিবিরের স্কুলে সংগীত ও কলা বিষয়ে শিক্ষকতা করে যা উপার্জন করেন, তা দিয়েই এখন পরিবার চালান বশিরুল্লাহ।
তিনি বলেন, 'আমরা এখানে ভালোই আছি। কিন্তু মর্যাদার সঙ্গে একদিন মাতৃভূমিতে ফিরে যাব, সেই স্বপ্ন দেখি।'
রাখাইনে ফিরে আসার আকুতি প্রায়শই পাওয়া যায় ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ সায়েদুল্লাহর কবিতায়। সায়েদুউলাহ একজন রোহিঙ্গা যুবক, শরণার্থীদের বীভৎস জীবন তুলে ধরার জন্য যিনি ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছেন ইতোমধ্যে।
এরশাদ ও বশিরুল্লাহর মতো সায়েদুল্লাহর ভক্তরা শুধু শিবিরের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও কবিতা প্রকাশ করে ভক্তদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন সায়েদুল্লাহ।
'শরণার্থী জীবন ২০১৭' শীর্ষক কবিতাটি ছিল ফেসবুকে প্রকাশিত তার প্রথম কবিতা।
'কবিতাটি ছিল দুঃখ, দুর্দশা ও স্বপ্ন ঘিরে। আপলোড করার পর আমি আশা করিনি দর্শক প্রতিক্রিয়া এত বিশাল হবে। সম্ভবত কবিতার কথাগুলো মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে, বলেন সায়েদুল্লাহ।
তিনিও অন্যদের মতো নিজ ভূমিতে ফিরে যাবার অপেক্ষায় রয়েছেন।
'প্রতিটি মানুষের জীবনে তিনটি জিনিস দরকার: জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। এই শিবিরে আমাদের জীবন আছে ঠিকই, কিন্তু নেই কোনো স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা,' বলেন তিনি।
- আরব নিউজ থেকে অনুবাদ: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত