ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকে আছে বাংলাদেশের আমদানিকৃত ২৫ হাজার কন্টেইনার
তৈরী পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্লিফটন গ্রুপ আমেরিকা থেকে ৩ কন্টেইনার কাঁচামাল আমদানি করে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে এসে করোনার পর আমদানির পরিমাণ বাড়ায় ফিডার ভেসেলের অভাবে ১ মাস ২০ দিন আটকে ছিলো এই পণ্য। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ১ সপ্তাহ আগে কলম্বো বন্দর থেকে ফিডার ভ্যাসেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে এই পণ্য। কিন্তু চট্টগ্রামে পৌঁছার পর প্রায় ৩ দিন সময় লাগে বার্থিং পেতে।
ক্লিফটন গ্রুপের মতো দেশের অনেক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা শিল্পের কাঁচামাল (প্রায় ২৫ হাজার টিইউস কন্টেইনার) দীর্ঘ দিন ধরে আটকে আছে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে। সবচেয়ে বেশি কন্টেইনার শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে আটকে আছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি শিপিং লাইন।
করোনার প্রভাবে গত নভেম্বরে কলম্বো বন্দরে শ্রমিকেরা কর্মবিরতিতে গিয়েছিল। যার কারণে এখনো জট রয়েছে বলে তারা জানায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া কন্টেইনারবাহী পণ্য বাংলাদেশে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট সিঙ্গাপুর, মালেশিয়ার পোর্ট কেলাং হয়ে আসে। এসব কন্টেইনারে রয়েছে সুতা, শিল্প কারখানার কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে সৃষ্ট জটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যবাহী কন্টেইনার পৌঁছানো এবং ডেলিভারি নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশী ক্রেতাদের সঠিক সময়ে তৈরী পোষাক রপ্তানি করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকায় কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া কন্টেইনারবাহী পণ্য প্রথমে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে নামানো হয়। এরপর সেসব বন্দর থেকে কন্টেইনারগুলো ফিডার ভ্যাসেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে এসব পণ্য হাতে না পেয়ে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন আমদানিকারকরা।
ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে প্রায় প্রতিটি গার্মেন্টস কোম্পানির কন্টেইনার আটকে থাকার ঘটনা ঘটছে। ইউরোপ থেকে যেসব কন্টেইনার আসছে বেশিরভাগই সেসব ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকে আছে'।
অন্যদিকে চলমান লকডাউনের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিক সময় থেকে প্রায় ৩০-৪০% ডেলিভারি কমে যাওয়ায় এই সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
নিদির্ষ্ট সময়ে পণ্য না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেকেই রমজানের জন্য পণ্য আমদানি করে ধরতে পারছেন না রমজানের বাজার। একই সাথে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসার খরচ যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতা থেকে আদায় করতে হয় ব্যবসায়ীদের।
মেডিটেরিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) সহকারী মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'কলম্বো বন্দরে আমাদের শিপিং লাইনের প্রায় ৯ হাজার টিইউস কন্টেইনার আটকে আছে। ওই বন্দরে জাহাজ জটের কারণে আমাদের কন্টেইনারগুলো জাহাজীকরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় আমদানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে এনে খালাস এবং আমদানিকারকের ডেলিভারি নেওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। এসব কন্টেইনারে শিল্পের কাঁচামাল থাকায় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে'।
তিনি বলেন, 'অনেক ফিডার অপারেটর মহামারী চলাকালীন বড় জাহাজের পরিবর্তে ছোট জাহাজ অপারেট করেছে তাই কম ধারণক্ষমতার জাহাজ হওয়ায় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে'।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং বিজিএমইএ'র পরিচালক এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'করোনার কারণে এই সংকট তৈরী হয়েছে। কন্টেইনার প্রতি বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে আমাদের। তার উপর চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার আসার পরও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপ্তরিক দৌরাত্ম্যের কারণে কন্টেইনার ডেলিভারি বিলম্ব হয়। এই অবস্থায় কারখানার উৎপাদন ধরে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়েছে'।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের নতুন নির্বাচিত চেয়ারম্যান সৈয়দ আরিফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শিল্পের কাঁচামালের পাশাপাশি রোজার মৌসুমকে কেন্দ্র করে আমদানি হওয়া পণ্যও আটকা আছে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে। এর ফলে সময়মতো পণ্য হাতে না পেলে বাজার হারাবে ব্যবসায়ীরা। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে কন্টেইনার আটকে থাকার ঘটনা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে'।
এদিকে গত ১ মাস থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কন্টেইনারবাহী জাহাজের বার্থিং পেতে সময় লাগছে ২ থেকে ৩ দিন। গত মাসে স্ক্র্যাপ পণ্যবাহী জাহাজের বার্থিং পেতে সময় লেগেছে সর্বোচ্চ ২৬ দিন। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর সেই পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পরও লকডাউনে সংকটে ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার ডেলিভারি কমে গেছে প্রায় ৩০- ৪০ভাগ। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে ৫ হাজার কন্টেইনার ডেলিভারি হলেও লকডাউনের শুরু থেকে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজারে। কন্টেইনার ডেলিভারিতে এমন ধীরগতির কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরের ইয়ার্ডেও বাড়তে শুরু করেছে কন্টেইনার সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে লকডাউন শুরু হওয়ায় কন্টেইনার ডেলিভারি কমতে শুরু করে। পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম দিনরাত ২৪ ঘন্টা চলমান আছে। কিন্তু বন্দর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শতভাগ সচল না থাকায় কন্টেইনার ডেলিভারিতে এর সুফল পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের নতুন নির্বাচিত পরিচালক মুনতাসির রুবাইয়াত বলেন, 'ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে বার্থিং ডিলে রয়েছে ২ থেকে ৩ দিন। এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সেখানে জাহাজ জট তৈরী হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ফিডার ভ্যাসেল আগে মাসে দুইবার পণ্য পরিবহন করতে পারলেও এখন লাগছে দেড় মাসের চেয়েও বেশি। ফলে সময়ের ব্যবধানে আটকে থাকা কন্টেইনারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাহাজ সংকট এবং বার্থিং ডিলের কারণে দ্রুত কন্টেইনার পণ্য আনাও সম্ভব হচ্ছে না'।
করোনা পরিস্থিতিতে বন্দরের কার্যক্রম শতভাগ সচল রাখার লক্ষ্যে গত ১২ এপ্রিল একটি নির্দেশনা জারি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ওই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ডেলিভারি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য পরিবহন বিভাগ, শিপিং এজেন্টস, বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর, শিপ হ্যান্ডেলিং অপারেটর, অন্যান্য বন্দর ব্যবহারকারীগন কাস্টমস বিভাগকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক বলেন, লকডাউনে বন্দরের কার্যক্রম যথারীতি ২৪ ঘন্টা সচল আছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে ডেলিভারি কমেছে। তবে তা এখনো বড় কোন সংকট তৈরি করেনি।
চট্টগ্রাম পোর্ট 'টাইডাল পোর্ট' হওয়ায় জাহাজ বার্থিংয়ে জোয়ার-ভাটার বিষয় থাকে, তাই বার্থিং পেতে ২-৩ দিন লাগে।