বঙ্গবন্ধুর নামে ১৫ একর ফলের বাগান গড়লেন আইয়ুব আলী
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের আইয়ুব আলী। অভাবের কারণে ১৯৯২ সালে এসএসসি পাস করেই তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। নানা কারণে আর এগোয়নি পড়ালেখা।
একাগ্রচিত্তে মন দেন কৃষিকাজে। এক যুগেরও বেশি সময় কৃষির পিছনে ব্যয় করে ঘোরেনি ভাগ্যের চাকা। শুরু করেন নার্সারি ব্যবসা। এতে কিছুটা আশার আলো দেখতে পান। চিন্তা করতে থাকেন কিভাবে এটাকে প্রসারিত করা যায়।
পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দেশি-বিদেশি ফলগাছের কলম ও চারা সংগ্রহ শুরু করেন। প্রথমে বাড়ির পাশে ৪০ শতাংশ জমিতে তা রোপণ করেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বাগানের পরিধি। বর্তমানে ১৫ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন একটি মিশ্র ফল বাগান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে বাগানের নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু মিশ্র ফল বাগান’।
ফলগাছের প্রতি আইয়ুব আলীর রয়েছে বিশেষ ভালোবাসা। গত ১৪ বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছেন শতাধিক প্রজাতির ফল গাছ। এরমধ্যে চায়না-৩ লিচু, থাই বাউকুল, থাই বেদানা, ড্রাগন ফল, মাল্টা, কমলা, ইরাকি লেবু, আলু বোখরা, থাই জামরুল, আঙ্গুর, মিষ্টি কামরাঙা, মিষ্টি তেতুঁল, সবেদা, থাই করমচা, পেঁপে, দেশি-বিদেশি বেল, আমড়া, বিভিন্ন জাতের কাঁঠাল, হিমসাগরসহ বিভিন্ন জাতের আমগাছ, বারোমাসি কলম করা কাঁঠালগাছ, পেয়ারাসহ রয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক ফলের গাছ।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নানা জাতের আম ও কিশোরগঞ্জের মঙ্গলবাড়িয়া থেকে লিচুর চারা এনে ফল বাগানকে সমৃদ্ধ করেছেন। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নার্সারির ব্যবসা শুরু করা আইয়ুব আলীর মূলধন আজ অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে। বর্তমানে তার বাগানের আয়তন ১৫ একর। স্বাবলম্বী আইয়ুব এখন অনেকের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
আইয়ুব আলী বলেন, এসএসসি পাস করার পর অভাব অনটনসহ নানা প্রতিবন্ধতায় আর লেখাপড়া করতে পারিনি। তখন থেকে হাল ধরতে হয় সংসারের। কৃষি কাজের পাশাপাশি ভাগ্যের অন্বেষণে বিভিন্ন চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হই। শুরু করি নার্সারির ব্যবসা। নার্সারি বাগান থেকে কিছুটা লাভবান হই।
২০০৬ সালে ৪০ শতাংশ জমিতে প্রথম ফলের বাগান করেন জানিয়ে তিনি বলেন, কলা বাগান দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে ওখানেই লিচুর চারা লাগাই। কিশোরগঞ্জের মঙ্গলবাড়িয়া থেকে লিচুর চারা এনে বাগান করে সফলতা পাই। পরে দিনাজপুর থেকে আরো লিচু এবং রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নানা জাতের আমের চারা এনে পাশ্ববর্তী ৫০ শতাংশ জমিতে রোপন করি। এক দিকে বাগানে লিচু আর আমের চারা বেড়ে উঠছে, অন্যদিকে সাথী ফসল হিসেবে আনারস, কাঁচা মরিচ, বেগুন, আদা, হলুদ চাষ শুরু করি। প্রথম বছরেই সাথী ফসল থেকে ব্যাপক সাফল্য পাই। দুই থেকে তিন বছরে আম আর লিচুর ফলন আসতে শুরু করে।
পাঁচ বছরের মাথায় লিচু ও আম বাগান থেকে পূর্ণমাত্রায় ফলন পাই। বর্তমানে আমার পাঁচ একর জমিতে আম আর লিচুর বাগান রয়েছে। যার থেকে প্রতি মৌসুমে খরচ বাদে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার আয় হয়। সব মিলিয়ে আমার ১৫ একর মিশ্র ফলের বাগান থেকে বছরে সব খরচ বাদ দিয়ে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা আয় হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আইয়ুব আলীর রয়েছে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সেই শ্রদ্ধা থেকেই তার ফল বাগানের নাম দেন ‘বঙ্গবন্ধু মিশ্র ফল বাগান’।
১০ একর জমিতে মাল্টা, কমলা, ইরাকি লেবুসহ অন্যান্য প্রজাতির বাগান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক হাজার চারা দিয়ে ২০১৬ সালে আমি মাল্টা চাষ শুরু করি। চলতি বছরেই প্রথম বেশ কিছু গাছে ফলন এসেছে। বাগানের প্রথম ফল তাই কিছু নিজেরা খেয়েছি, কিছু আত্মীয়-স্বজনদের দিয়েছি। তারপরও অবশিষ্ট মাল্টা ৩০ হাজার টাকার বিক্রি করেছি।
তার নিজের বাড়িটিই একটি ফল বাগান। বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে বারোমাসি বিভিন্ন ফলগাছ। তার স্ত্রী এগুলো দেখাশোনা করেন। যে কেউ তার বাড়িতে বেড়াতে গেলে গাছ থেকে পেড়ে আনা ফল দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করেন।
আইয়ুব আলী দীর্ঘ আলাপচারিতায় আরও জানান, ফলগাছ লাগানো তার নেশা। ২০১৫ সালে সড়কের দুই পাশে ফলগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছুদিন পরেই সন্তোষপুর কান্দুর বাজারের পশ্চিমপাশ থেকে সড়কের এক পাশে ফলগাছের চারা লাগানো শুরু করেন। বাঁধা দেন সন্তোষপুর রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ। এক বছর বন্ধ থাকে গাছ রোপন কার্যক্রম। পরে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলী কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আবারও শুরু করেন চারা লাগানো কার্যক্রম।
রাস্তার দুই পাশের আট কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ছয় কিলোমিটারের বেশি অংশে সাড়ে তিন হাজার ফলজ গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আম, জাম, কাঁঠাল, আমড়া, জলপাই, পেয়ারা, জাম্বুরা, করমচা, বেল, আতা, অরবরই, চালতা, চাম্বল, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। কিছু কিছু গাছ বেশ বড় হয়ে গেছে। কিছু গাছ ফলও দিতে শুরু করেছে। গাছগুলো যেন গবাদি পশুর দ্বারা বিনষ্ট না হয় সেজন্য রেখেছেন মাসিক বেতনভিত্তিক দু’জন শ্রমিক।
আইয়ুব আলী জানান, স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। তার প্রতি কাজে উৎসাহ জোগান স্ত্রী কল্পনা বেগম।
একই এলাকার যুবক ইসলাম উদ্দিন জানান, বাবার জমি থাকার পরও বেকার ছিলাম। জমিকে কিভাবে কাজে লাগাবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ আইয়ুব আলী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তারা কাছ থেকে চারা, কলম ও পরামর্শ নিয়ে বাগান করি। আজ আমিও ফল বাগান করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবদুল মাজেদ বলেন, ফুলবাড়িয়ার উপজেলায় যে কয়েকজন ফল বাগানের মালিক রয়েছেন তাদের মধ্যে আইয়ুব আলী অন্যতম। আইয়ুব আলী দীর্ঘ ১৫ বছর সংগ্রাম করে আজ প্রতিষ্ঠিত। একটি সফল মিশ্র ফল বাগানের মালিক তিনি।