কোভিড: আইভারম্যাকটিন, দুধের মতো ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার অপ্রমাণিত সব মহৌষধ
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে কোভিড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আবারও ভুয়া ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন তথ্যের প্রচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
কোভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যখাতে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়তে থাকা রোগীর সংখ্যা, অক্সিজেন সংকট এবং সাহায্যপ্রার্থী স্বজনদের ক্রমাগত আহ্বানে সাড়া দিতে দেশটির হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে।
বিপর্যস্ত এই পরিস্থিতির মাঝেই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন ভ্রান্ত তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে জনপ্রিয় হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয় এমন কিছু কোভিডের টোটকা সামনে আনা হয়েছে। এক নজরে সেগুলো দেখে নেওয়া যাক-
১। কোভিড চিকিৎসায় আইভারভ্যাকটিনের অনুমোদন নিয়ে মিথ্যা প্রচার
কৃমি ও অন্যান্য পরজীবী সংক্রমণ রোধে ব্যবহৃত অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ আইভারভ্যাকটিনের প্রচারণা দিন দিন বাড়ছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম ইন্দোনেশিয়ান কর্তৃপক্ষের আইভারমেকটিনের জরুরি অনুমোদন প্রদানের ভুল সংবাদ প্রচার করে।
ওষুধটির কার্যকারিতা নিয়ে এখনও ট্রায়াল চলছে। কোভিড সাড়াতে আইভারমেকটিনের কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দিষ্ট ক্লিনিকাল ব্যবস্থার অধীনে ওষুধটি ব্যবহারের বিষয়ে বারবার সতর্ক করলেও বহু জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আইভারম্যাকটিনকে কোভিড চিকিৎসায় কার্যকর হিসেবে প্রচারণা করেছেন।
আইভারম্যাকটিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক জানায়, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আইভারম্যাকটিনের কার্যকারিতার এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট ড. ডিকি বুডিমান বলেন, "পরামর্শ ব্যতীত ওষুধটি সেবন করা উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধটি সেবনে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।"
তবে, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে আইভারম্যাকটিনকে কোভিডের সম্ভাব্য চিকিৎসা উপাদান হিসেবে ব্যবহারে গবেষণা চলছে।
২। নেসলের বিয়ার ব্র্যান্ডের দুধ খেলে তৈরি হবে অ্যান্টিবডি
বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে যে, ইন্দোনেশিয়ানরা নেসলের বিয়ার ব্র্যান্ডের দুধ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়েছে।
নেসলের দুধ খেলে কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন সম্ভব- এমন একটি দাবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে প্রচারিত হয়। এরপরই বাজারে এই দুধের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে, দুধটির দামও ৪৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
এই দাবির সূত্রপাত কোথায় তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে, দুধ খেয়ে কোভিডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা নেই।
ইন্দোনেশিয়ার নেসলে কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে জানায় যে, প্রতিষ্ঠানটি কখনোই তাদের পণ্য থেকে অ্যান্টিবডি তৈরির দাবি প্রচার করেনি। কোভিডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবলমাত্র ভ্যাকসিন গ্রহণ বা পূর্বে আক্রান্ত হলে অর্জন করা সম্ভব।
৩। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক টোটকা
মৌমাছি সৃষ্ট আঠালো পদার্থ প্রপোলিসের ব্যবহারে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
টুইটার এবং ফেসবুকে অনেকেই কোভিডের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতে প্রপোলিসের কার্যকারিতা দাবি করছেন।
প্রপোলিস মূলত প্রদাহ কিংবা ক্ষতস্থানে প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২০১৮ সালের প্রথাগত চিকিৎসার অংশ ও ওষুধ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রপোলিস বিক্রির অনুমোদন দান করে।
ইন্দোনেশিয়ায় 'ব্রিটিশ প্রপোলিস' নামে পরিচিত ইনস্টাগ্রামের অফিশিয়াল একটি পেজে ওষুধটিকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে দাবি করা হয়। তবে, তাতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা ছিল না।
তবে, অ্যাকাউন্টটির একটি পোস্টে 'মাস্ক পরিধানের পাশাপাশি' প্রপোলিস সেবনে 'দেহের ভেতরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষেধ' হিসেবে প্রপোলিস ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু, কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে ওষুধটির কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ নেই।
শুধু ইন্দোনেশিয়াই নয়, মহামারির সময় অন্যান্য দেশেও 'প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী বুস্টার' হিসেবে প্রপোলিসের প্রচারণা দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ড. ফাহিম ইউনুস বলেন, 'ইম্যুনিটি বুস্টার' শব্দটি অনেকক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে পারে। তার মানে এই নয় যে, এই উপাদানগুলো কোভিডের বিরুদ্ধেও কার্যকর।
এছাড়া, ইন্দোনেশিয়ার কোভিডের বিরুদ্ধে একাধিক ভেষজ ওষুধ ব্যবহারের প্রচারণা দেখা গেছে। এরমধ্যে আছে চামড়ার প্রদাহে ব্যবহৃত ব্যাকটেরিয়া বিরোধী ক্যাজুপুট তেল।
গুজব রয়েছে এই তেল সেবনে বা শ্বসনের মাধ্যমে গ্রহণে করোনা প্রতিরোধ সম্ভব।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এই তেলের কার্যকারিতা নিয়েও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বরং, শ্বসন প্রক্রিয়ায় এই তেল গ্রহণে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
সূত্র: বিবিসি